জিজ্ঞাসু : মাত্র ৫ বছর বয়সে আপনার মাতৃদর্শন হয় ?

গুরুমহারাজ : হ্যাঁ, আমার তখন ৫ বছর বয়স, প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। ছোটবেলায় আমি ঐ রকম ছিলাম বলে আমার এক দিদির উপর মা আমার ভার দিয়েছিলেন, যাতে সঙ্গে করে আমাকে স্কুলে নিয়ে যায় বা নিয়ে আসে। কিন্তু দিদিরও তো অল্প বয়স, একটা বাড়তি দায়িত্ব নিতে সে রাজী হবে কেন ? অভিভাবকদের ভয়ে সে দায়িত্বটা নিয়েছিল বটে কিন্তু তার জন্য আমার লাঞ্ছনা ও বড় একটা কম ছিল না ! আমি তখন শিশুশ্রেণীতে পড়ি, ফলে আমাদের আগে ছুটি হত কিন্তু মায়ের আদেশ ‘দিদির সঙ্গে বাড়ী আসবি।’ তাই চুপটি করে দিদির ছুটি না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকতাম । সব ছেলেরা চলে যেতো, দিদির ছুটি হলে আমাকে দেখতে পেয়েই বিরক্ত হতো সে। এক-একদিন মাথায় গাঁট্টা মারতে মারতে বা ঠেলতে ঠেলতে বাড়ী নিয়ে আসতো। একদিন হয়েছে কি, ওরা বন্ধু- বান্ধব মিলে ঠিক করেছে – স্কুল যাওয়ার পথে যে পেয়ারাবাগান ছিল সেখান থেকে পেয়ারা চুরি করবে। কিন্তু ফেরার পথে আমি থাকলে মুস্কিল—যদি বাড়ীতে বলে দিই তাহলে মায়ের হাতে নির্ঘাত মার । আর ছোটবেলা থেকেই সত্যি কথা বলা আমার স্বভাব। এমনকি অন্য কেউ মিথ্যা কথা বললেও ধরতে পারতাম। যে কোন মানুষের মুখ দেখে বলে দিতে পারতাম—সে সত্যি বলছে কিনা। এটাকে পাশাপাশি বাড়ীর লোকেরা কাজে লাগাতো। কারও কিছু হারিয়ে গেলে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি-টিষ্টি খাইয়ে জিজ্ঞাসা করত, ‘বলত বাবা, অমুক জিনিসটা কোথায় আছে বা কে নিয়েছে ?’ আমি অনেক সময় অপরাধী হাজির থাকলে নামটা বলে দিতাম, কোন কোন সময় এড়িয়ে যেতাম।

যাইহোক্, এইসব কারণে দিদি আমাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। তাই স্কুল যাবার সময় বলেই দিয়েছিল যে, স্কুল থেকে সেদিন যেন আমি একা-একাই ফিরি। আমিও সানন্দে বলেছিলাম ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটুকু পথ আমি একাই যেতে পারবো।’ ফলে সেদিন স্কুল-ছুটির পর বই বগলে নিয়ে আমি গুটি গুটি পায়ে বাড়ীর দিকে হাঁটছি। তখন স্কুল থেকে আমাদের বাড়ী আসার পথে অনেকগুলি কলাবাগান পড়তো আর বসতিও তখন কম ছিল, ফলে রাস্তাঘাট জনশূন্য ছিল। এখন সে সমস্ত জায়গায় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লোকেরা ঘরবাড়ী করে ফেলেছে আর ততটা ফাঁকা নেই। আর রাস্তার উপরে একটা ডোবার ধারে আমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখে একটা শিবমন্দির ছিল। আমার চেনা রাস্তা—প্রতিদিনই স্কুল যাই, কাজেই অসুবিধার কোন কারণ ছিল না।

কিন্তু হল কি জানো, শিবমন্দিরের কাছে যেই এসেছি, হঠাৎ দেখি একজোড়া কুকুর মিথুনরত অবস্থায় রাস্তার মাঝাখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কখনও ঐ অবস্থায় কোন কুকুর দেখিনি, ফলে অবাক- বিস্ময়ে ঐ কুকুর দুটির দিকে তাকিয়ে আছি, কতক্ষণ ঐভাবে ছিলাম জানি না, হঠাৎ দেখি আমার ঠিক বিপরীত প্রান্তে অর্থাৎ কুকুরগুলোর ওদিকে আমারই বয়সী একটি মেয়ে বড় বড় চোখে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। মেয়েটির গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, একঢাল কালো চুল পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। পরনে লাল পেড়ে খাটো শাড়ী— আঁটোসাঁটো করে বাঁধা, আর কপালে মস্ত একটা লালরঙের টিপ। আমি তার দিকে তাকাতেই সে আমাকে বলল, “কি দেখছিস্, জগৎ ? আয় আমি তোকে জগৎ দেখাবো।” এই বলে সে এগিয়ে এসে কুকুর দুটোর গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মাঝখানে বসল, আমিও এগিয়ে গেলাম তার চোখে চোখ রেখে। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে যেই ঐ কপালের লাল রঙের টিপটার দিকে নজর গেল, অমনি মনে হল সেই টিপটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, আর সেটা বড় হতে হতে এত বড় হল, যেন তা দিকচক্রবাল ছাড়িয়ে সীমাহীন হয়ে গেল আর আমার চেতনা যেন তার মধ্যে কোথায় বিলীন হয়ে গেল। ঐখানে বেহুঁশ হয়ে কতক্ষণ পড়েছিলাম তার ঠিক নেই। দিদির ছুটি হবার পর সে পেয়ারা চুরি করে সেগুলো খেয়ে তবে বাড়ী গেছে। যাওয়ামাত্রই মায়ের খোঁজ “ভাই কই ?” তারপর আমার খোঁজ—সবাই দৌড়ে বেরিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজতে শুরু করেছে। তারপর বাবা আমাকে শিবমন্দিরের কাছে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখতে পান। প্রথমে সবাই ভেবেছিল—বুঝি সাপে কামড়ে আমি মারা গেছি। কারণ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে কলাবাগানে সাপের খুব উৎপাত হয় আর ঐ সময়ই আমাদের পাড়ার একটি ছেলে সাপে কেটে মারাও গিয়েছিল।

এরপর বাড়ী নিয়ে গিয়ে মুখে-চোখে জল দেবার বহুক্ষণ পর আমার চেতনা ফিরে এল। তখন দেখি মায়ের ব্যাকুল মুখখানি আমার মুখের উপর ঝোঁকা। আমার মাও কপালে বেশ বড় সিঁদুরের টিপ পরতেন। আমার চোখ সেই সিঁদুরের টিপের দিকে যেতেই ফের তা বড় হতে হতে দিকচক্রবাল ছাড়িয়ে গেল, ফলে পুনরায় আমি চেতনা হারালাম। ঐ অবস্থাটা আমার একটানা বেশ কয়েকদিন ছিল। তারপর অনেকটা সুস্থ হ’লাম। কিন্তু ঐ যে মেয়েটি সে আমাকে আর ছাড়েনি। আমার সাথে-সাথেই সেও বড় হয়েছে আর সদা-সর্বদা আমার সঙ্গে থেকেছে। প্রথম কয়েকমাস যে আমার কি অবস্থা গেছে । খেতে দিতো না, শুতে দিতো না, শুধুই জগৎজ্ঞান, জগত্রহস্য দেখাতো আর শেখাতো।

রাত্রে সবাই ঘুমালে আমাকে ডেকে নিতো, তারপর বাইরে কোথাও নিয়ে চলে যেতো। কোথায় সে নিয়ে যায়নি ? গাছের ডালে, দিঘির জলে, পাহাড়ের মাথায়, মাঠের আলে—রাতের পর রাত কেটে গেছে তার সঙ্গে আমার। বাবা জানতে পেরে এক-একদিন আমার জামার সঙ্গে গায়ের কাপড় বেঁধে রাখতেন, কিন্তু সে ঠিক খুলে দিতো। উঁচুতে খিল দিয়ে রাখতো বাবা, যাতে আমি নাগাল না পাই। সেই আমাকে কি করে খিল খুলতে হবে তা শিখিয়ে দিতো। একদিন রাত্রে পুকুরের উপর দিয়েই টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পাশের বাড়ীর কাকীমা দেখে মাকে বলল, ‘তোমার ছেলেকে নিশিতে পেয়েছে দিদি, রাত্রে দেখলাম তোমার ছেলে জলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল।” আসলে উনি তো আর তাকে দেখতে পাননি, শুধুই আমাকে দেখেছেন ফলে ঐ রকম ধারণা করেছেন। মা আর কি করেন ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করিয়ে নিলেন। তারা নানান অত্যাচারও করেছিল শরীরের উপর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না দেখে তারা আর আসেনি।