জিজ্ঞাসু : আচ্ছা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পরই আপনি গৃহত্যাগ করেন ?

গুরুমহারাজ : যেমন করে তুমি বলছ গৃহত্যাগ, ঠিক এমনি কিন্তু আমার গৃহত্যাগ হয়নি। আমি গর্ভধারিণী মাকে বোঝালাম, সংসারে অভাব, কিছু রোজগার করা তো দরকার—তাহলে ট্রেনে ১ হকারী করে কিছু রোজগার করা যায়। মা বুঝলেন এবং অনুমতিও দিলেন। এভাবেই আমার বাইরে বেরনো শুরু হল। তারপর কোথায় না গেছি ! বর্ধমান জেলার বহু গ্রামেই আমি গেছি। সমগ্র হিমালয় পর্বতমালার যে কয়েক হাজার চূড়া রয়েছে, তার সমস্ত চূড়াই পায়ে হেঁটে হেঁটে আমাকে ঘুরতে হয়েছে মা জগদম্বার নির্দেশে। সমগ্র ভারতবর্ষের কোণে কোণে মা আমাকে নিয়ে গেছে—এমনকি প্রাচীন ভারতবর্ষ অর্থাৎ অখণ্ড ভারতবর্ষ—ষোড়শ মহাজনপদ এবং কিছু বাইরের অঞ্চল নিয়ে ‘জম্বুদ্বীপ’ নামে যা পরিচিত ছিল, তার সমস্ত এরিয়্যা আমি পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি। এরমধ্যে পড়ে যাবে ধর —পশ্চিমে পাকিস্তান, বর্তমান আফগানিস্থান, পুস্কলাবতী বা কাফ্রিস্থান, এছাড়া ইরাকের বাগদাদ পর্যন্ত—যার প্রাচীন নাম ছিল ভগদত্তনগরী এবং পূর্বদিকে ব্রহ্মদেশ ও উত্তরে তিব্বত পর্যন্ত। এর সমস্তটাই আমি পায়ে হেঁটে ঘুরেছি—যার জন্য ভ্রমণকালে আমাকে দু’বার সীমান্তে ধরা পড়তে হয়েছিল। একবার পাকিস্তানীরা এবং অন্যবার চীন সীমান্তরক্ষীরা ধরেছিল। চৈনিকরা একটু ভদ্র হলেও পাকিস্তানীরা খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। ওদের ঊর্ধ্বতন অফিসার এসে আবার আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল।

যাইহোক, এই যে পায়ে হেঁটে, ট্রেনে, বাসে, যেভাবে সুযোগ পেয়েছি—ভারতবর্ষকে কাছ থেকে দেখেছি, তাতে জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। পৃথিবীগ্রহের অনেক সংস্কার আমাকে এখানে এসে তৈরী করে নিতে হয়েছে। আর তাছাড়া মা আমাকে বললেন —শরীর যখন নিয়েছ এই গ্রহে তখন এই গ্রহের সব কিছুই তোমাকে দেখতে হবে—জানতে হবে। ফলে পৃথিবীগ্রহের চরম ভাল দিক, যেমন শ্রেষ্ঠ সাধু-সন্ন্যাসী, জ্ঞানী, ভক্ত, তপস্বীদের মা দেখিয়েছেন আবার দেখিয়েছেন কপট, ভণ্ড, ভেকধারী, দুর্নীতিপরায়ণদের এবং সেই সাথে সমাজের অবক্ষয়, শোষণ, অত্যাচার, বলাৎকার, দারিদ্র ও কামনার জঘন্য রূপ। চরম

তবে আমি সব থেকে কাতর হয়েছি নিরন্ন মানুষকে দেখে, যারা একমুঠো অন্ন পায় না খেতে। এর থেকে মানবিকতার চরম অপমান আর কি হতে পারে—যেখানে বা যে দেশে Five Star হোটেল রয়েছে, বিলাসবহুল অট্টালিকা রয়েছে এবং উৎসব-অনুষ্ঠানে অন্নের যথেচ্ছভাবে অপচয় হয়ে থাকে। আমার ছেলেদের বলেছি, আশ্রমে এসে অভুক্ত অবস্থায় যেন কেউ ফিরে না যায়। তোমরাও গৃহে এটা লক্ষ্য রাখবে। আমার তো এই কটা আশ্রমই আশ্রম নয়। আমার সন্তানদের অনেক গৃহই আশ্রম হবে – সেগুলি হবে ‘পরমানন্দ গৃহাশ্রম’। যাইহোক্‌, দেখবে আমি ঐজন্য গরীবদের—নিরন্নদের বেশী ভালোবাসি। আমি দেখেছি মানুষ গরীব হলে ঈশ্বরকে ডাকে, প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে। গালাগালি দিলেও ঈশ্বরকেই দেয়। কিন্তু মানুষ ধনী হয়ে গেলে সে ঈশ্বরবিমুখ হয়ে পড়ে। অবশ্য সবাই নয়, তবুও বেশীর ভাগেরই এই দশা হয়। তাই আমার ভক্ত ধনী হতে শুরু করলেই আমি চিন্তায় পড়ে যাই—এবার হয়তো সে আমাকে ভুলে যাবে !