জিজ্ঞাসু : কিসের আওয়াজ ছিল সেটা ?
গুরুমহারাজ : একজন প্রাচীন সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বরের।
জিজ্ঞাসু : মানুষের অত জোর আওয়াজ কি করে সম্ভব ? গুরুমহারাজ : হ্যাঁ সম্ভব। নাদ-বিজ্ঞান আছে না, সাধুরা জানেন ঐ নাদ-বিজ্ঞান। দ্যাখো, সাধু-সন্তরা বনে-জঙ্গলে-পর্বতে থাকেন, যেখানে হিংস্র পশুরা বাস করে। বিশেষত গুহাগুলির দখল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় সাধুদের – কেননা বাঘ, সিংহ, ভল্লুক এরাও তো গুহায় থাকতে ভালোবাসে, নিরাপদ আশ্রয় আর কে না চায় ! সাধুরা দেখলেন যে, একই জঙ্গলে বাঘ এবং সিংহরা থাকতে চায় না আর থাকলেও সিংহদের কাছ থেকে বাঘেরা নিরাপদ দূরত্বে থাকে। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেল যে, বাঘেদের ‘হালুম’ শব্দের থেকে সিংহের নাদ ‘ঘ্রাম-ম-ম’ অনেক গম্ভীর, প্রায় বজ্রপাতের মতো ৷ এটাতেই ভয় পায় বাঘ। শব্দের প্রাবল্য অন্যদের dominate করে। নেকড়ের ডাক শুনলে কুকুররা ভীষণ ভয় পায়। তাছাড়া এমনিতে দেখবে যখনই জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীর সম্মুখীন হয় মানুষ তখন টিন, কানেস্তারা বাজিয়ে সোরগোল তোলে আর তাতেই ভয় পেয়ে ওরা পালায়। এখন অবশ্য বোম, বন্দুকের যুগ, ফলে জীবজন্তুদের ভয় দেখানো মানুষের কাছে আর কষ্টকর নয়। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই সাধু-সন্তরা এই বিজ্ঞান রপ্ত করে রেখেছিলেন যাতে প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারেন ।
এই সাধুটিও নাদবিজ্ঞান এবং ত্রাটকবিজ্ঞান দুটোতেই সিদ্ধ ছিলেন, পরে অবশ্য তাঁর অন্য অনেককিছুর সাথেই পরিচয় হল। যাইহোক প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে আকাশবাণীর ন্যায় আগত শব্দকে follow করতে লাগলাম। উপরের দিকে পর্বতের গায়ে তাকিয়ে একটা প্রাচীন পথেরও সন্ধান পেলাম। ঝোপঝাড় ঠেলে ঠেলে পাহাড়ি পথ ধরে ধরে উঠতে থাকলাম উপরে। মাঝে মাঝে নির্দেশ আসছে ‘ডাইনা’ অথবা ‘বাঁয়া’। এইভাবে প্রায় দেড় / দুই কিমি চড়াই ভেঙে উপরে উঠে দেখলাম একটা প্রশস্ত জায়গা আর দূরে পর্বতের গায়ে একটা গুহার মতো কিন্তু মুখটা পাথর দিয়ে ঢাকা। কতকাল যে ঢাকা দেওয়া আছে তার ঠিক নেই কারণ গুহা-মুখের চারিদিকে গাছগাছালির ঝোপঝাড় গড়ে উঠেছে।
সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি এবং ভাবছি নির্দেশটা ঐ গুহা থেকেই না অন্য কোথাও থেকে আসছিল ! এমন সময় গুহা থেকেই নির্দেশ এল পাথর সরিয়ে ফেলার। ফলে নির্দেশমতো গুহামুখ থেকে পাথরটা সরাতে সরাতে ভাবছি কি আশ্চর্য, এত উঁচুতে গুহামুখ বন্ধ অবস্থায় গুহার ভিতর বসে কি করে দেখা সম্ভব যে, নীচে একজন রয়েছে আবার নির্দেশ দিয়ে দিয়ে নিয়ে আসছেন—একি সিদ্ধিরে বাবা ! হয়তো কোন বিরাট যোগী—এই ভাবতে ভাবতে পাথরটা সরিয়ে পরমাগ্রহে গুহার ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমার সমস্ত ভাবনারও ছেদ পড়ল আর শরীরে এক ধরণের শিহরণ খেলে গেল। কি দেখলাম জানো—কত বছরের অব্যবহৃত জমাটবাঁধা অন্ধকার গুহার মধ্যে শুধু যেন এক জোড়া জ্বলন্ত চোখ। একটা ভ্যাপসা গুমোট আবহাওয়া, যেন আমার শরীর সহ্য করতে পারছে না। কিছুক্ষণ থাকার পর চোখটা গুহার অন্ধকারের সঙ্গে সেট হয়ে গেল এবং পরিবেশটা শরীর মানিয়ে নিল। তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম—যিনি বসে আছেন তাঁকে আর মানুষ বলে বোধ হচ্ছে না। শুধু একটা কঙ্কালের উপর যেন চামড়াখানা টাঙানো আছে আর চোখের গহ্বরটা বেশ কয়েক ইঞ্চি ভিতরে ঢোকা কিন্তু তাতেই জ্বলন্ত চক্ষু আর ঐ বজ্রের মতো আওয়াজ ! দেখে মনে হচ্ছিল শরীরে প্রাণের কোন স্পন্দনই নেই। যাইহোক আমি প্রণাম করে তাঁর কাছে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি আমাকে ওখানে ডেকেছেন ?
এবার সহজ গলায় আমাকে তিনটি জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল ‘লোহে কা চিড়িয়াঁ আকাশ মে উড়তা হ্যায় কিয়া ?’ আমি বুঝলাম উনি এ্যারোপ্লেনের কথা জানতে চাইছেন, তাই আমি উত্তর দিলাম, ‘হাঁ জী।’ উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “লোহে কা হংস পানীমে তৈরতা হ্যায় ?” বুঝলাম এবার উনি জলজাহাজের কথা জানতে চাইছেন, ফলে আবার উত্তর দিলাম, “হাঁ জী।” ওনার শেষ জিজ্ঞাসা ছিল, “পানীসে আগ বনতী হ্যায় কিয়া ?” আমি বুঝলাম জলবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে কিনা জানতে চাইছেন। ফলে এবারও উত্তর দিলাম, “হাঁ জী।” উনি এবার প্রসন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তেরে হি ইনতিজার মে থা অব মেরা জানেকা ওয়াক্ত আগয়া !” এরপর উনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসলেন, আদর করলেন ও আশীর্বাদ করলেন। তারপর উনি সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বললেন – ‘আমার গুরু ৬৪ কলাবিদ্যার শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছেন এবং বলেছেন যখন আকাশে লোহার পাখি, জলে লোহার হাঁস এবং জল থেকে আগুন তৈরি হবে তখন এক বালকবেশী মহাযোগী আমার কাছে আসবেন। তিনিই এই কলাবিদ্যাসমূহ গ্রহণ করার উপযুক্ত আধার। তাঁকে ঐগুলি না শোনানো অবধি আমাকে স্থূল শরীর নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। এখন সেই উপযুক্ত সময়, তুমি এসেছ – তোমাকেই ঐ সকল বিদ্যা অর্পণ করে আমি দায়িত্বমুক্ত হতে চাই।’ আমার মন-মেজাজ তখন ভালো নেই—নাঙা সন্ন্যাসীদের বিরহে কিছু ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম ঐসব মাথায় ঢুকিয়ে লাভ নেই আবার চিন্তা করলাম আমি এগুলি না শুনলে ওনার মুক্তি নেই—তখন শেষে এই সিদ্ধান্ত নিলাম- —আমি এখন শুনি পরে ওয়াস আউট করে ফেলব। উনি তখন পালি ভাষায় ৬৪ কলাবিদ্যা সূত্রাকারে তিন ঘণ্টা ধরে বললেন। তারপর উনি ওখানেই দেহত্যাগ করলেন। আমি ওখানেই তাঁর শবদেহ সৎকার করলাম। কিন্তু সেই যে বিদ্যা শুনলাম—তা আর মাথা থেকে বের করে দিতে পারলাম না—মাথায় তা প্রিন্ট হয়ে গিয়েছিল। উনি বৌদ্ধ আমলের আড়াই হাজার বছরের যোগী ছিলেন।
তবে পরবর্তীকালে যখন সমাজে মানুষের জন্য কাজ করতে নেমে আসতে হ’ল তখন ঐ সন্ন্যাসীর প্রদত্ত সিদ্ধির প্রচুর কার্যকারিতা পেয়েছি এবং আজও সেগুলোর দ্বারা বহু মানুষের কল্যাণ হয়ে চলেছে। আমি তোমাদের বলিনা—কত যে দধীচির আত্মত্যাগ হয়ে চলেছে মানবকল্যাণের জন্য—মানব কোনদিনই তার খোঁজ পাবে না !