জিজ্ঞাসু : গুরুমহারাজ, ঘটনাটা একটু বলুন ?
গুরুমহারাজ : ঘটনাটা ঘটেছিল কি, আমি তখন যাচ্ছিলাম নেপাল থেকে হিমালয়ের একটা জায়গায়, যেখানে মাইলের পর মাইল শুধুই কলাগাছের বন রয়েছে। সাধুরা যেটাকে কদলীবন বলেন। অন্য গাছও রয়েছে অনেক, কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে বিভিন্ন ঝরনার ধারা প্রবাহিত হয়েছে স্থানটি দিয়ে, আর ঐ কদলীবনের সৃষ্টি হয়েছে । ফলে স্বভাবতই ঐ বনকে ঘিরে হাতির পালের বাস আর সহস্র সহস্র হনু বা বাঁদরের বাস। আমার ঐ বনে যাবার একটা উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হল—সাধু পরম্পরায় কথিত আছে হনুমান, অশ্বত্থামা, বিভীষণ ইত্যাদি কয়েকজন নাকি বহুকাল শরীর ধারণ করে রয়েছেন, এঁদের মৃত্যু হয়নি, তাই অনেকেই আমায় বলেছিলেন—হনুমান যদি শরীর ধারণ করে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ঐ কদলীবনেই থাকবেন, ফলে হনুমানের সন্ধানেই ওখানে যাওয়া। পরে একটা হনুই আমার প্রাণরক্ষা করেছিল, সে কথায় পরে আসছি, আগে হাতির সামনে থেকে কি করে বাঁচলাম সেটাই বলি।
হাতির একটা মস্ত দল আমি যে পথে যাচ্ছিলাম সেই পথেই আসছিল। হিমালয়ের রাস্তা মানেই একদিকে গভীর খাদ অপরদিকে খাড়া পাহাড়। একটা বাঁক ঘুরতেই আমি একেবারে হাতির পালের সামনা-সামনি পড়ে গেলাম। পিছিয়ে পালাবারও ক্ষমতা নেই কারণ অনশনক্লিষ্ট দেহ, তাই আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দলপতি একটা বিশাল দাঁতাল হাতি সামনে ছিল – সেও দাঁড়িয়ে গেল শুঁড় তুলে। পুরো দলটার এমন discipline যে, দলপতি দাড়ানোর সাথে সাথে ঐ ১০০/১৫০টি হাতি পরপর দাঁড়িয়ে গেল। পিছনের হাতিরা তো আমায় দেখতে পাচ্ছে না শুধু দলপতিকে অনুসরণ করেই দাড়িয়ে গেল। খুব দ্রুত আমি চিন্তা করে নিলাম যে, কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কি করা যায় চট করে, গায়ের জীর্ণ জামাটা খুলে ডান হাতে নিয়ে একবার বাঁদিকে আর একবার ডানদিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে দোলাতে শুরু করে দিলাম। দলপতি হাতিটি জামার গতিবিধি লক্ষ্য করে তার মাথাটা একবার বাঁদিকে এবং একবার ডানদিকে হেলাতে লাগল। এবার একটা কাণ্ড হোল। ঐ দলের সমস্ত হাতি দলপতির দেখাদেখি ব্যাপারটা কি হচ্ছে না বুঝেই তাদের নিজেদের মাথাও একবার বাঁদিকে আর একবার ডানদিকে ঘোরাতে লাগল। এইভাবে কিছুক্ষণ করার পর আমি পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে কিছুটা উঁচুতে উঠে পড়লাম যাতে হাতিরা নাগাল না পায়। আর ওখান থেকেই লক্ষ্য করতে থাকলাম হাতিরা কি করে। দেখলাম কিছুক্ষণ মাথা নড়ানোর পরই দলপতিটা হঠাৎ খেয়াল করল, আরে সামনে তো কেউ নেই, তখন সে ধীরে ধীরে গজেন্দ্র গমনে হাঁটা শুরু করল, বাকী হাতিরাও তাকে follow করে আগাতে শুরু করল। তখনই উঁচু থেকে আমি লক্ষ্য করলাম যে, দলটিতে হাতির সংখ্যা প্রায় ১০০-র বেশী।
এরপর হাতিরা চলে যেতেই আমিও উঁচু থেকে নেমে এসে আবার চলতে শুরু করলাম। একেবারে কদলীবনের মাঝামাঝি জায়গায় এসে একটা ঝরনার ধারে এক গাছতলায় বসে বিশ্রাম নেব মনস্থির করলাম। রাস্তায় একটা লালমতো বড় ফল পেয়েছিলাম, ওটা বনের আগুনেই ঝলসে নিয়ে সঙ্গে রেখেছিলাম। ওখানে বসে মনে করলাম ফলটা খেয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করব। কারণ কদলীবনে কলাতো পাকবার জো নেই, হনু-বাঁদরের দল পাকার আগে থেকেই সেগুলোকে কামড়াতে শুরু করে। যাইহোক ক্লান্ত দেহে একটু বসে ফলটাকে পাশে রেখে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ হতেই দেখি আমার পাশ থেকে ঝলসানো ফলটা নিয়ে একটা হনুমান আবার একলাফে গাছে উঠে পড়ছে, আমি আর কি করি, ভাবলাম কতক্ষণ পর আহার্যের জন্য এই ফল গ্রহণটাও ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়—তাহলে তাঁর ইচ্ছাটাই মেনে নেওয়া যাক। এটুকু ভাবতে ভাবতেই আবার ধপ্ করে একটা শব্দ আর গোঙানি আওয়াজ শুনে পিছন ফিরেই দেখি সেই হনুটা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে এবং তার মুখ দিয়ে ফেনা ফেনা গ্যাজলা বেরোচ্ছে। বুঝতে পারলাম ফলটা বিষফল ছিল। এমনিতে ওরা বিষফল চেনে, কিন্তু ঝলসানো থাকায় বিবর্ণ হয়েছিল বুঝতে পারেনি। সমবেদনায় আমার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল। আমার প্রাণের বিনিময়ে নিরীহ প্রাণীটির প্রাণ যেতে বসেছে দেখেই দৌড়ে আমি ঝরনার জলে আমার জামাটা ভিজিয়ে নিয়ে এসে নিংড়ে ওর মাথায়-মুখে দিতে লাগলাম। এইভাবে কয়েকবার জামা ভিজিয়ে জল দেবার পর ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে সারা শরীরটাকে ম্যাসেজ করতে লাগলাম আর গ্যাজলা বের করে করে ওর মুখটা পরিষ্কার করতে লাগলাম । আমি আমার স্বভাব অনুযায়ী ঐ আর্তের সেবায় একভাবে কাজ করছি, খেয়াল করিনি যে হনুর দল কখন গাছ থেকে নেমে এসে আমার চারপাশে ঘিরে বসেছে, আর একদৃষ্টে লক্ষ্য রাখছে যে, আমি কি করছি। আমার মনে হল যদি হনুটার কিছু হয় তো ওরা আমাকে সমবেতভাবে হয়তো এ্যাটাক করবে। কিন্তু আমি ভাল-মন্দ চিন্তা না করে সেবাকাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। বহুক্ষণ অচেতন থাকার পর ধীরে ধীরে হনুটির চেতনা এল, ও উঠে বসল। তারও বহুক্ষণ পর ও টলতে টলতে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের নীচে চলে গেল। হনুর পালও আমাকে ছেড়ে ওকে follow করে সেখানে জড়ো হল। আর এই ফাঁকে আমিও ঝরনা পেরিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলাম।
এইভাবে রামায়ণের হনুমানের সাথে দেখা করতে গিয়ে বনের হনুমান আমার প্রাণ রক্ষা করেছিল। তবে ওখানে বহু মহাপুরুষ বা যোগীরা সূক্ষ্ম শরীরে বা অণিমা, লঘিমা সিদ্ধি অবলম্বন করে রয়েছেন যাঁদের অনেকের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিল।