জিজ্ঞাসু : আর একটা কি ঘটনার কথা বলছিলেন ?
গুরুমহারাজ : হ্যাঁ, ঐ ঘটনাটা আরও চমকপ্রদ। যদিও ঘটনাটির সরাসরি সাক্ষী আমি নই, তবে গুরুদেব রামানন্দজী স্বয়ং ঘটনাটির সাক্ষী ছিলেন। কারণ উনি তখন যুবক অবস্থায় উত্তরকাশীতেই থাকতেন অর্থাৎ ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগেকার। ফলে তখন যাঁরা হিমালয়ের বিভিন্ন তীর্থদর্শনে যেতেন তাঁদের হাঁটাপথ ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। সেইরকমই একটা দল নিয়ে এক লালাজী চলেছিলেন গঙ্গোত্রীর পথে। সঙ্গে অন্যান্য লোক ছাড়াও খাবার-দাবার, লোটা-কম্বল বইবার লোক, রান্না করার লোক এসবও ছিল। তখনকার দিনে বা আজও যারা পায়ে হেঁটে হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে যায়, তাদের সারাদিনে কতটা হাঁটতে হবে, কোথায় দুপুরের খাওয়া, কোথায় রাত্রে বিশ্রাম তার একটা নির্দিষ্ট চার্ট থাকে। ঐটা ফেল করলেই পুরো দলটারই একদিন যাত্রা নষ্ট হয়ে যাবে। ঐ জন্য দলের কারও একজনের শরীর খারাপ হলে বা অন্য কোন অসুবিধা হলে, সঙ্গের লোকেরা তাকে কোন ধর্মশালায় রেখে এগিয়ে চলে যায়। এখানে ব্যাপারটা একটু অমানবিক মনে হলেও করার কিছু থাকে না। কারণ লিমিটেড সময়, লিমিটেড খাবার বা পোশাক নিয়ে একটা দিন বেশী নষ্ট করা মানেই তো হয় সব তীর্থ শেষ না করে ফিরতে হবে, না হলে শেষের দিকে উপবাসে থাকতে হবে। তখনকার দিনে ঐসব দুর্গম অঞ্চলে বেশী ধর্মশালাও ছিল না আর যদিও ছিল সেখানে কর্তৃপক্ষরা থাকতে দিলেও হয়তো খেতে দিতো না। আজও অনেক ধর্মশালায় খেতে দেয় কিন্তু গৃহীদের দেয় না। মালায় সাধুদের বিনা পয়সায়
সে যাইহোক, লালাজী তাঁর নির্দিষ্ট পথ ধরে দলবল নিয়ে যেতে যেতে উত্তরকাশীর ১০/১২ কিমি আগে কোন একটা জায়গায় ঝরনার ধারে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেছে। পাচক তাড়াতাড়ি খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়েছে আর বাকীরা ঝরনার জলে স্নানাদি সারতে শুরু করেছে। এদিকে ঘটনা ঘটেছে কি, পাচকটি দেখেছে হাতা-খুন্তি এসব আর বের করে কি হবে, এখনই তো তাকেই আবার সেগুলো ধুয়ে বাঁধাছাদা করতে হবে। ফলে ওসব বের না করে সে ওখানেই পড়ে থাকা একটা শুকনো গাছের ডালকে ধুয়ে নিয়ে খিচুড়ি ঘাঁটতে শুরু করে দিল। কিন্তু তা করতে গিয়েই বিপত্তিটা হল। ঐ কাঠটা গরম খিচুড়ির সংস্পর্শে আসার পরই খিচুড়িটা কেমন লাল রঙের থকথকে মতো হয়ে গেল। পাচকটির তো খুব ভয় হয়ে গেল, লালাজী জানতে পারলে খুবই বকাবকি করবেন কারণ ওতটা চাল- ডাল নষ্ট ! ফলে পাচক করল কি, খিচুড়িটা তাড়াতাড়ি অন্য জায়গায় সরিয়ে রেখে চাপা দিয়ে হাঁড়ি ভাল করে ধুয়ে আবার খিচুড়ি চাপিয়ে দিল আর হাতা খুন্তি বের করে তাই দিয়ে ঘাঁটতে লাগল। আর কাঠটাকে রাগে ঝরনার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এরপর লালাজীর দলবল এসে নতুন রান্না হওয়া খিচুড়ি খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়েই আবার যাত্রা শুরু করল। কারণ সন্ধ্যার আগে উত্তরকাশী পৌঁছতে হবে। এদিকে পাচকটি সবার খাওয়া হলে হাঁড়ি-থালা ধুয়ে গুছিয়ে নিজে খেতে বসে দেখল যে, সদ্য রান্না হওয়া খিচুড়ি শেষ। তখন বাধ্য হয়ে খিদের তাড়নায় সে ঐ চাপা দেওয়া লাল থকথকে খিচুড়িটাই খেয়ে নিল। অন্যান্য দিন সাধারণত মোট বওয়ার লোক আর পাচক একটু পরেই যাত্রা করে, তারপর তাড়াতাড়ি হেঁটে দলের লোকদের ধরে ফেলে। সেদিনও সেইরকমই হবার কথা – ি —কিন্তু খিচুড়ি খাবার পরই পাচকটির গায়ে ভীষণ temperature এসে গেল আর তেমনি তীব্র যন্ত্রণা। মাল বইবার লোকগুলো এসব দেখে স্থানীয় কোন গ্রামে লোকটিকে রেখে কিছু পয়সা দিয়ে মূল দলের সঙ্গে যোগ দিল । সবাই ভাবলো হয়তো সে মারা যাবে। কিন্তু হল কি—প্রথমে লোকটির শরীর ফুলতে শুরু করল। তারপর শরীরের সমস্ত অংশ ফেটে গিয়ে রস বেরোতে লাগল। কিছুদিন পর থেকে সেই ঘাগুলো শুকিয়ে যেতেই শরীর থেকে খোলস ছাড়ার মতো সমস্ত চামড়া উঠে গেল। এমন কি মাথার চুলসমেত চামড়াও উঠে গেল। তারপর লোকটি একটি নবীন যুবায় পরিণত হল। সুন্দর লাবণ্যময় শরীরে তাকে ঋষিকুমার বলে মনে হচ্ছিল। স্থানীয় মানুষদের চোখের সামনে এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা বিস্মিত। এদিকে সে সুস্থ হয়েই লালাজীর দলের সঙ্গে যুক্ত হবার বাসনা জানাতে লাগল। ফলে স্থানীয় মানুষেরা তাকে সঙ্গে করে উত্তরকাশী পৌঁছে দিল এবং সমস্ত ঘটনা ওখানকার সাধুদের জানাল। ফলে গোটা উত্তরকাশীর সাধু- সমাজে একটা হৈ হৈ পড়ে গেল। অনেকেই ঐ কিশোররূপী পাচকটিকে দেখতেও এসেছিল। এদিকে লালাজী গঙ্গোত্রী ঘুরে ১০/১১ দিন পর আবার উত্তরকাশীতে এসে হাজির। লালাজীকে দেখে ছেলেটি চিনতে পেরে প্রণাম করতে গেল কিন্তু লালাজী দীপ্তিমান কিশোরকে ঋষিবালক মনে করে ‘রাম’ ‘রাম’ শব্দ করে জিভ কেটে পিছিয়ে গেলেন পাঁচ হাত। পরে উপস্থিত সাধুদের মুখে সব ঘটনা শুনে লালাজী প্রথমটায় খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর ব্যবসায়িক বৃত্তি জেগে গেল। লালাজী বুঝতে পারলেন – খিচুড়ি ঘাঁটা হয়েছিল যে কাঠটায়, ঐ কাঠই হচ্ছে সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি। ফলে যদি ঐ গাছটার একবার সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে ঐ গাছের ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালেই যে কোন বয়সের লোক যুবক হয়ে যাবে । আর তাহলে সারা পৃথিবীর মানুষ লালাজীর কাছে ছুটে আসবে এবং তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হ’বেন। চিন্তা মাথায় আসতেই লালাজী পাচকটিকে নিয়ে টানতে টানতে সেই পূর্বের জায়গায় এসে হাজির। সেখানে কয়েকদিন আগের রান্না করার বা থাকার বহু চিহ্ন পড়ে ছিল, ছিল না শুধু ঐ কাঠটা। কয়েকদিন ওখানে তাঁবু খাটিয়ে পড়ে থেকে লালাজী কত কাঠ কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে কত হাঁড়ি খিচুড়ি রাঁধলেন কিন্তু ঐ রকমটা আর হল না।
ঐ অঞ্চলেরই কোন গাছের ডালের মধ্যেই আছে ঐ বিশেষ দ্রব্যগুণ যা শরীরের R.N.A কে কমিয়ে শুধু D.N.A বাড়িয়ে দিচ্ছে ফলে শরীরের ক্ষয় হচ্ছে না, বরং শরীরকে দ্রুত পরিবর্তন করে দিচ্ছে। কিন্তু দেখো—আজ পর্যন্ত গাছটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তার মানে ঈশ্বরের ইচ্ছা নয় যে, গাছটি লোকসমক্ষে আসুক। সাধুরা কিন্তু জানেন, কোথায় কি আছে, কিন্তু তাঁরাও ঈশ্বরের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। তাঁরা জানেন সাধারণ মানুষ টাকার জন্য ভাই, বন্ধু, বাবা-মাকেও প্রয়োজনে হত্যা করে, নির্যাতন করে আর টাকার জন্য হিমালয়ের ঐ দুষ্প্রাপ্য কটা গাছকে তো একদিনেই শেষ করে দেবে। ফলে তাঁরা চাইলেন—হিমালয়ের সম্পদ হিমালয়েই থাক। ঐ মহান সাধুকুল যেগুলি রক্ষা করছেন, সাধারণ মানুষের কি ক্ষমতা সেগুলির ক্ষতি করে !