জিজ্ঞাসু : আপনি বলেন, ‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ’ ?
গুরুমহারাজ : নিশ্চয়ই ! ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। কেন তোমার কি তাঁকে ততটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে ? তাহলে অন্তত তাঁর জীবনের পরিপূর্ণতা দেখ । যখন যে কাজ করছেন কতটা নিখুঁত তিনি ! ষোলআনা মনকে কোন কাজে নিয়োগ করতে পারলে তবেই তন্ময়তা আসে তবেই কোন কাজ নিখুঁত হয়। ভগবান ছাড়া আর কার পক্ষে তা সম্ভব ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোটবেলায় অভিনয় করেছিলেন কামারপুকুরে, তিনি শিব সেজেছিলেন, অভিনয় চলতে চলতেই তিনি সমাধিস্থ – শিব সেজেছেন কিন্তু শিব হয়ে গেছেন —পারবে এই অভিনয় করতে ? গঙ্গার তীরে পলিমাটি দিয়ে মূর্তি গড়তেন। এত নিখুঁত যে, চোখ ফেরানো যেতো না। মথুরবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন কিন্তু গদাই সেগুলিকে আবার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে দিতেন। যখন রাধাগোবিন্দের মূর্তি ভেঙ্গে গেল –ঠাকুর বিধান দিলেন মূর্তি পালটাতে হবে না, গোবিন্দের ভাঙ্গা পা জুড়তে হবে— কে জুড়বে ঠাকুর ছাড়া । অত নিখুঁত করার সাধ্য কার ? এমন নিখুঁত করে জুড়ে দিলেন যে রাসমণি নিজেই অবাক !
প্রথমদিকে ঠাকুর মন্দিরে চাকরি নিতেই অস্বীকার করেন এইজন্যই যে, তাঁর ভাব কর্তৃপক্ষ না বুঝলে অনর্থ হবে, তারপর যখন তাঁর প্রতি মথুরবাবুর ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রাবল্য দেখা দিল তখন ঠাকুর সম্মত হয়েছিলেন বেশকারী বা ঠাকুর সাজাবার কাজ নিতে। আর সে কাজটাও ঠাকুর এত তন্ময় হয়ে করতেন—এত সুন্দর করে সাজাতেন যে, মৃন্ময়ী প্রতিমা যেন চিন্ময়ী হয়ে উঠত। আবার তিনি নিজে একবার-দুবার নারী সেজেছিলেন, তাও এতটা নিখুঁত ছিল যে, তাঁর কাছের লোকেরাও তাঁকে চিনতে পারেননি। এরপরে তিনি মূর্তি পূজার ভার নেন। তাঁর পূজা মথুরবাবু অবাক হয়ে দেখতেন— অতবড় রাজসিক ব্যক্তিরও চোখের জল বাধা মানতো না। তিনি রাণী রাসমণির কাছে ছোট ভট্চাযের পূজার কথা গল্প করতেন। তারপর যখন কালীঘরে হালদার বাড়ির পুরোহিত দল পাকিয়ে রাণীর কাছে গদাই-এর নামে Complain করল, তখন রাণী সেই অছিলায় ঠাকুরের পূজা দেখতে এসেছিলেন। ঠাকুর তখন নিজের ভাবে বিভোর হয়ে নিজেরই পুজো করছেন, মাকে খাওয়াতে গিয়ে নিজেই খাচ্ছেন, মায়ের মালা নিজেই গলায় পরছেন—সে এক অপার্থিব দৃশ্য ! রাণীর দুচোখে অশ্রুধারা – মথুরবাবু অবাক! অভিযোগকারীর দল পালিয়ে বাঁচল। রাণী ফরমান জারি করলেন—ছোট ভট্টচাযের কাজের কেউ কোন প্রতিবন্ধকতা করবে না। পুরোহিত হালদারমশাই নিরস্ত হল না বরং আরও ক্রুদ্ধ হ’ল। একদিন গদাই ভাবস্থ অবস্থায় মন্দিরপ্রাঙ্গণে পড়ে আছেন, শরীরবোধ নেই—ঠাকুরের সে এক অবস্থা —ঘন ঘন সমাধিস্থ হতেন তিনি। যাইহোক কাছাকাছি কেউ নেই দেখে হালদারমশাই নিজের পা দিয়ে ঠাকুরের পায়ের বুড়ো আঙুল থেঁতলে ধরে বলেছিলো, “বল্ না, রাণীকে আর জামাইকে কি করে বশ করলি, বল না ?” সেই মুহূর্তে হয়তো ঠাকুরের শরীরবোধ ছিল না কিন্তু সম্বিৎ ফিরলে আঙুলটিতে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়, ওখানে দু’চারজন সেবক ঠাকুরকে ভালোবাসত, তারাই ঘটনাটা ঠাকুরকে বলে। সব শুনে ঠাকুর যন্ত্রণা চেপে চুপ করে যান। তিনি জানতেন যে, যদি মথুরবাবু ঘটনাটা জানতে পারেন তাহলে হালদারকে তো তাড়াবেনই হয়তো খুন করেও ফেলতে পারেন। পরে কিন্তু হালদারমশাই নিজের দোষ স্বীকার করে ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। সালোক্য-সামীপ্য-সাযুজ্য-সার্টি। সালোক্য বা সামীপ্যে থাকলেও সকলে কি লীলায় প্রবিষ্ট হতে পারে ? বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উল্টোটাই হয়—মহাপুরুষ বা অবতার-পুরুষের সান্নিধ্যে থেকে উত্তরণ লাভ করা খুবই কঠিন।
তবে ঐ যে বলেছিলাম ভগবান ষড়ৈশ্বর্য্য্যবান। ফলে নিকটবর্তীরা যদিও একটু সরে যাচ্ছিল তারা আবার কাছে চলে আসে। ‘মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ’–বলে যে কথাটা আছে তার রহস্য এটাই। তাঁর সান্নিধ্যে থাকলে ব্রহ্মলোকে স্থিতিলাভ ঘটে। এটা কম কথা নয়। একবার গোমুখ যাবার পথে সি. এল. শর্মা এরকমই বলেছিল। ওখানে হয়েছিল কি, শর্মাজীদের Family member-রা উঠে যাবার পরই একটা কয়েক টনের পাথর নিচের দিকে গড়িয়ে নামতে থাকে। নিচে তখন আমি, তপিমা–তাছাড়া আরও অনেক যাত্রীরা পরপর উঠে যাচ্ছিলাম। পাথরটা ঠিকমতো পড়লে সবাইকে পিষে ফেলবে বা ধাক্কা মেরে খাদে ফেলবে, এই আশঙ্কায় যখন সবাই আশঙ্কিত তখন ওটা একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে আমার মাথায় পড়ল, সবাই অকস্মাৎ আতঙ্কে চোখ ঢেকেছিল। তারপর চোখ খুলে দেখে যে, আমি ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি, আর পাথরটা টুকরো টুকরো হয়ে নিচে ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে। শর্মাজীরা যাই বলুক আমি কি দেখলাম জানো তো—আমার শরীর থেকেই একটা anti-gravitational force সৃষ্টি হয়ে ঐ পাথরটার gravitation-কে নিষ্ক্রিয় করে দিল আর ওটা শোলার বলের মতো ছিটকে পাশের খাদে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে গেল। রহস্যটা আমি বুঝে গেলাম যে, কয়েকটন পাথর কেন—একটা গোটা পাহাড়কে যে হনুমান ঘাড়ে করে এনেছিল অথবা কৃষ্ণ যে গোবর্ধন গিরি ধারণ করেছিলেন—এসব কোন অতিরঞ্জিত ঘটনা নয়—ঘটা সম্ভব। যে কোন ব্যক্তির এই বিজ্ঞান জানা থাকলেই তিনি তা প্রয়োগ করতে পারেন।