জিজ্ঞাসু—এতক্ষণ যে শক্তির কথা বললেন—এগুলি তপস্যায় লাভ হয়, না আরাধনায় ?
গুরুমহারাজ—তপস্যায় সিদ্ধি আসে আর আরাধনায় ঈশ্বরকে লাভ করা যায়। তপস্যায় প্রাপ্ত সিদ্ধি আবার ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ মহামায়ার নিয়মকে অতিক্রম না করা হয়, এটা করলে আবার সিদ্ধিও নষ্ট হয়ে যায়। উত্তরকাশীতে একজন সাধু প্রায় বারো বছর ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যা করছিল। তার ডান হাতটা উপর দিকে থেকে থেকে কাঠের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। ন’কাকা যখন আমার সাথে উত্তরভারত গিয়েছিল তখন ওকে দেখেছিল। যাইহোক মহামায়ার এমনিই মোহিনী মায়া, তার বারো বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র ৭দিন বাকি—এমন সময় সে এমন একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেললো যে, তার দীর্ঘ বারো বছরের তপস্যা ভঙ্গ হয়ে গেল। সম্ভবত ও একটা বিশেষ কিছু সৃষ্টি করার সংকল্প নিয়ে তপস্যা করছিলো কিন্তু মা জগদম্বার ইচ্ছা নয় যে, সেটা হোক, তাই তপোভঙ্গ। আর মজার ঘটনাটা কি হলো জানো, তার দু-একদিন আগে থেকেই আমরা ওখানে হাজির ছিলাম। আমার সাথে তপীমায়ের মা- বাবা এবং আরও কিছু ভক্তরাও ছিল। ফলে কোন ঘটনায় ওর তপোভঙ্গ হয় তা আমরা বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছিলাম। কয়েকটি স্থানীয় যুবক ওনার আশ্রমের কাছাকাছি পিকনিক করছিল। তাদের একটি দল আশ্রম দেখতে এসে হয়তো আশ্রমের গাছের কোন ডাল-পাতা ভেঙেছে বা ফুল-ফুল ছিঁড়েছে—ব্যস্ এই নিয়েই অশান্তি শুরু । আশ্রমিকদের সঙ্গে ছেলেগুলির ঝগড়াঝাঁটি থেকে মারামারি শুরু হয়ে গেল। সাধুবাবা চোখের সামনে এসব দেখে স্থির থাকতে না পেরে তার আসন থেকে নেমে ছুটে এল ছেলেগুলিকে মারতে। এতে গণ্ডগোল থেমে গেল কিন্তু ক্রোধবশত সাধুটির হাত নীচে নেমে যাওয়ায় তার এতদিনকার তপস্যা ভঙ্গ হয়ে গেল। পরে যখন আমি আবার হিমালয়ে যাই খবর নিয়ে জেনেছিলাম—সাধুটি একটি জার্মানী মেয়েকে বিবাহ করে সুখে সংসার করছে। তার তপস্যার ফল হয়তো এইভাবেই লাভ হল।
জিজ্ঞাসু—আপনি অনেকসময় শিরদাঁড়া খাড়া করে বসার কথা বলেন—এতে নাকি মস্তিষ্কের উন্নতি হয়, কিন্তু আমরা ছবিতে দেখি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ খাড়া হয়ে বসে নেই—এটা কেন ?
গুরুমহারাজ—হ্যাঁ আমি বলেছিলাম—শিরদাড়া খাড়া করে যে বসতে পারে না, জানতে হবে তার আত্মশক্তির বা ইচ্ছাশক্তির অভাব আছে। কিন্তু তাই বলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে সবার সাথে মিশিয়ে ফেলো না। যে ফটোটায় দেখা যায়— –ঠাকুর সুখাসনে একটু ঝুঁকে বসে আছেন, ওটা ঠাকুরের মাতৃভাব। মা সন্তানকে দুধ দেবার সময় একটু ঝুঁকে বসেন। অনন্ত ভাবময় ঠাকুর কে ছিলেন আর কি ছিলেন তার অন্ত পাওয়া কি অতই সহজ! তাঁর জীবদ্দশাতেই স্বামী বিবেকানন্দ আর মা সারদা ছাড়া তাঁকে কে কতটুকুই বা
চিনেছিল ? সারদা মা ঠাকুরকে ‘মা জগদম্বা স্বয়ং’ বলে চিনেছিলেন। তাই ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পর ‘মা, তুমি কোথায় গেলে গো’—বলে কেঁদেছিলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মতো অবতারবরিষ্ঠ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীগ্রহকে ধন্য করে গেছেন। চৌষট্টি তন্ত্রের সাধনা করলেন তিনি এবং প্রত্যেকটায় সিদ্ধ হলেন। এক-একটা আচার সম্পন্ন করতে তাঁর একদিন, দুদিন অথবা তিনদিনের বেশী লাগেনি—ভাবা যায় ! যেখানে একটা তন্ত্রের আচার করতেই এক-একজন সাধকের এক জন্ম লেগে যায় অথবা একজন্মেও অনেকে পারে না—সেখানে কয়েকদিনের মধ্যে চৌষট্টি তন্ত্রের সাধন সম্পন্ন করা এটা স্বয়ং ভগবান ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব ! রামপ্রসাদ দক্ষিণাচার সিদ্ধ ছিলেন, বামদেব বামাচার (চিনাচার) সিদ্ধ ছিলেন, কমলাকান্ত বীরাচার। তাহলে সবতন্ত্রের সাধন করতে গেলে চৌষট্টি জন্ম লেগে যাবে। বহু পূর্বে মহাদেব সদাশিব এই ধরণের তন্ত্র সাধনা করেছিলেন। তাঁর পর তন্ত্র নিয়ে এত বড় re- search আর পৃথিবীগ্রহে হয় নি। মথুরবাবু, শ্রীশ্রী মা, হৃদয় আর যোগেশ্বরী ভৈরবী—যারা তাঁকে সাহায্য করেছিল, তারাও ধন্য, পঞ্চবটী ধন্য, দক্ষিণেশ্বরের মাটি ধন্য, এই পৃথিবীগ্রহ ধন্য। এই অতিলৌকিক ঘটনার সাক্ষী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বা যে স্থানে এই অসাধ্য-সাধন ঘটেছিল সেই স্থান চিরকাল মহিমান্বিত হয়ে থাকবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কাছে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আরও কত ভাবের সাধন করেছিলেন, এমনকি বিভিন্ন ধর্মমতের সাধনও করেছিলেন। এসব করে তিনি জগৎকে দেখালেন যে, সবই সত্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন—পৃথিবীতে যত ভাব আছে তাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। রমণমহর্ষি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেননি। একবার কোন একজন ঠাকুরের একটি ফটো তাঁকে দেখান। ভালো করে কিছুক্ষণ দেখার পর মহর্ষি রমণ বলেন, ‘এই ফটোটি এমন একজন মহাপুরুষের, যাঁর ফটো, যে কোন ধর্মমতের মানুষ ঘরে টাঙিয়ে রাখলে এবং এঁকে চিন্তা করলে তার উপকার হবে।’ ঠাকুরকে অবতারবরিষ্ঠ বলার এটাই অন্যতম কারণ যে, পৃথিবীতে যত অবতারপুরুষ এসেছেন, তাঁদের প্রচারিত ধর্মমতগুলির অনুগামীরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মাধ্যমেই নিজ নিজ ধর্মগুরুর শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুলি ধরতে পারবে। বা এককথায় বলা যায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সমস্ত অবতারপুরুষের প্রচলিত ধর্মমতের কাছেই বরণীয়, তাই তিনি অবতারবরিষ্ঠ।
আমি যখন হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরছিলাম তখন আমার সাথে কয়েকজন মহাত্মার সাক্ষাৎ হয় । এঁদের অত্যন্ত উচ্চ অবস্থা— লোকসমাজের সঙ্গে এঁদের কোন যোগাযোগই নেই, অথচ বহুকাল ধরে শরীরধারণ করে আছেন। এঁদেরকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওঁরা কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘উনি হরির অবতার’। অনন্ত ভাবময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে কে চিনতে পারে বলো ? গিরিশ ঘোষ বলেছিলো – ‘ব্যাস-বাল্মিকী যাঁর বর্ণনা করতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছেন, আমার কি সাধ্য তাঁকে বর্ণনা করি’! তাই বলছিলাম ভগবানের সঙ্গে কখনও মানুষের তুলনা করতে যেও না, তাহলে ভুল হবে।