প্রশ্ন –হে দেব, পূর্বে আপনার নিকট হতে তন্ত্রের অপূর্ব বিশ্লেষণ শুনেছি । এখন যদি অনুগ্রহ করে দেহস্থ চক্রগুলি সম্পর্কে কিছু বলেন তো কৃতার্থ হই ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, পূর্বে তোমাকে চক্র সম্পর্কে বলেছি, এখন ঐ চক্রগুলির গূঢ় রহস্য তোমাকে বলছি, তুমি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর ।
মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাচক্র ও সহস্রার—যোগের ভাষায় এইগুলি যথাক্রমে পৃথ্বীগ্রন্থি, বরুণ গ্রন্থি,অগ্নিগ্রন্থি, বায়ুগ্রন্থি, ব্যোমগ্রন্থি, অহংগ্রন্থি ও মহগ্রন্থি । প্রতিটি চক্রে যথাক্রমে এই গ্রন্থিগুলি অবস্থিত । এক-একটি গ্রন্থির আবার পাঁচটি করে উপগ্রন্থি আছে।
প্রশ্ন—হে দেব, আপনি দয়া করে একটি একটি করে চক্রগুলির অবস্থান এবং মনিব শরীরে এদের কার্যকলাপ ব্যক্ত করুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, এখন তোমাকে মূলাধার চক্র বা পৃথ্বীগ্রন্থি সম্পর্কে বলছি । স্থূল শরীর উৎপন্ন করাই পৃথ্বীগ্রন্থির কার্য । পৃথ্বীগ্রন্থিপ্রধান ব্যক্তিদের দেহ হয় একটু স্কুল তথা ভারী। স্বভাবে এঁরা হন একটু সহিষ্ণু এবং উদার প্রকৃতির। এ দের ভিতর উদ্যম, উৎসাহ অত্যন্ত ক্ষীণ হয়। কোনকিছু প্রাপ্তির জন্য তেমন কোন ব্যাকুলতা বা আগ্রহ এঁদের ভিতর দেখা যায় না। সংসারের যাবতীয় বিরোধ এবং দুর্ভাবনাকে এঁরা পাশ কাটিয়ে চলতে অভ্যস্ত। এই গ্রন্থি প্রধান ব্যক্তিগণ সচরাচর স্বার্থপরায়ণ হন এবং সাংসারিক ভোগবিলাসের প্রতি আসক্ত হন
এখন ঐ মূলাধার চক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি। দেহস্থ কুণ্ডলিনী শক্তি প্রসুপ্ত বা নিদ্রিত অবস্থায় মূলাধারে অবস্থান করে— গুহ্য ও জননেন্দ্রিয়ের মধ্যভাগে এই চক্রে মুলাধার পদ্ম বিরাজমান । সুষুম্না নাড়ীমুখ ঐ পদ্মের সঙ্গে সংলগ্ন । ঐ পদ্ম রক্তবর্ণ, চতুর্দলযুক্ত, অধোমুখে প্রস্ফুটিত। অনুস্বারবিশিষ্ট চারটি। পীতবর্ণ অক্ষর যথাক্রমে বং, শং, ষং, সং দক্ষিণাবর্তে সন্নিবিষ্ট রয়েছে। এই মূলাধার পদ্মের মধ্যভাগে একটি চতুষ্কোণ ধরাচক্র বিদ্যমান। ধরাচক্রের মধ্যস্থলে পীতবর্ণ বিদ্যুতের ন্যায় উজ্জল লং বীজ বিরাজমান থাকে। এটাই পৃথ্বীতত্ত্বের স্থান। এই লং বীজকে পৃথ্বীবীজও বলা হয় । ঐ বীজের অভ্যন্তরে বিন্দুস্থানে নবীন সূর্যবৎ রক্তবর্ণ শিশুবৎ ব্রহ্মা উপবিষ্ট। তাঁর চার মুখে চার বেদ এবং চারহস্তে দণ্ড, কমণ্ডলু, অক্ষমালা ও অভয়মুদ্রা শোভা পাচ্ছে। তাঁর কোলে রক্তচক্ষু, তেজঃপুঞ্জশালিনী ডাকিনীশক্তি বিরাজমান। তাঁর চার হস্তে, শূল, খটাঙ্গ, খড়্গা ও চষক শোভা পাচ্ছে।
মূলাধার পদ্মের কণিকা অভ্যন্তরে সুষুম্নার মধ্যস্থিত বজ্রানাড়ীর মুখস্থানে একটি ত্রিকোণ যন্ত্র শোভিত আছে । তা জ্যোতির্ময়। ঐ ত্রিকোণ যন্ত্রের ভিতর বক ফুলের আকারে কন্দর্প বায়ু ও কামবীজ বিরাজমান। আবার ঐ কামবীজের অভ্যন্তরে বৃত্তাকার স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ অধোমুখে বিদ্যমান এবং ঐ স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের। ঊর্ধ্ব দেশে মৃণাল তন্তুর ন্যায় অতি সূক্ষ্মাকারে জগৎ মোহিনী কুণ্ডলিনীশক্তি বিরাজ মান। তিনি স্বীয় মুখ দ্বারা ব্রহ্মনাড়ীর মুখদেশ আচ্ছাদন করে আছেন এবং ব্রহ্মনাড়ী-বিগলিত চন্দ্রসুধা পান করছেন। তিনি সাপের মতো সাড়ে তিন পাকে। স্বয়ম্ভূ লিঙ্গকে বেষ্টন করে শিরোপরি প্রসুপ্ত রয়েছেন । আর ঐ কুলকুণ্ডলিনী শক্তিই মূলাধারে বিদ্যমান থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসরূপ বিবর্তন দ্বারা জগতের সমস্ত প্রাণিবর্গকে রক্ষা করছেন। তন্ত্রে একে বলা হয় ব্রহ্মগ্রন্থি ।
প্রশ্ন—দেব, আপনার মুখ হতে মূলাধার চক্র সম্পর্কে শুনলাম, এবার অনুগ্রহ করে আপনি স্বাধিষ্ঠান চক্র সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, স্বাধিষ্ঠান চক্র বা বরুণগ্রন্থি-নিঃসৃত রসধাতু হতে শুক্র গঠিত হয় এবং শুক্র হতে দেহের সমস্ত উপাদান গঠিতহয়ে থাকে ৷
বরুণগ্রন্থিপ্রধান ব্যক্তিদের স্বভাব অতি সহৃদয় হয় এবং এ দের ব্যবহারও খুব মধুর হয় । এঁরা সুন্দর, স্বাস্থ্যবান হন। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় খুব পারদর্শী হন এঁরা এবং ব্যবহারিক জীবনে খুব সুপ্রতিষ্ঠিত হন ।। এই গ্রন্থি বিশৃঙ্খল হলে সাধারণত মানব ঈর্ষাপরায়ণ, নিন্দুক, স্বার্থপর ও কামুক হয়।
এখন ঐ স্বাধিষ্ঠান চক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি । জননেন্দ্রিয়মূলে এই চক্রের অবস্থান সুষুম্নার মধ্যস্থ চিত্রাণী নাড়ী আর ঐ চিত্রাণী নাড়ীর অভ্যন্তরে লোহিতবর্ণ বিদ্যুৎ-উজ্জ্বল ষড়দলবিশিষ্ট স্বাধিষ্ঠান পদ্ম বিরাজিত এর ছয়টি দলে অনুস্বারযুক্ত সিন্দুরবর্ণবৎ নিম্নলিখিত অক্ষরসমূহ বিরাজমান, যথা—বং, ভং, মং, যং, রং, লং । এই পদ্মের অভ্যন্তরে অর্ধচন্দ্রাকারে শ্বেতবর্ণ বরুণমণ্ডল শোভা পাচ্ছে। ঐ মণ্ডলের ভিতর শ্বেতবর্ণ মকরবাহন বরুণ বীজ ‘বং’ বিদ্যমান ঐ বরুণ বীজের ক্রোড়ে নীলবর্ণ পীতাম্বর-পরিহিত শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মধারী চতুভুজ নারায়ণ গড় রোপরি উপবিষ্ট রয়েছেন। ঐ সাধিষ্ঠান পদ্মের কর্ণিকা অভ্যন্তরে নীলকান্তিযুক্ত। চতুভু জা, ত্রিনেত্রা, দিব্যবস্ত্রা-পরিহিতা, সালংকারা, ভীষণ দ্রষ্টা, রক্তধারা বিগলিত নাসাযুক্তা, উন্মত্তা রাকিনীশক্তি বিরাজমান। তাঁর চার হস্তে শূল, পদ্ম, ডমরু ও টঙ্ক শোভা পাচ্ছে।
প্রশ্ন—এবার কৃপাপূর্বক মণিপুরচক্র সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন।
উত্তর :–প্রিয় আত্মন্, মণিপুর চক্র বা অগ্নিগ্রন্থি দেহের তাপ রক্ষা করে দেহযন্ত্রের পরিচালনায় সাহায্য করে। এই গ্রন্থি আহার্য বস্তুকেদগ্ধ করে রস-রক্তে পরিণত করে এবং দেহগঠনে সহায়তা করে । অগ্নিগ্রন্থি-প্রধান ব্যক্তিগণ তেজস্বী ও উদ্যমী হন। এঁরা জনগণের ওপর নেতৃত্ব করে থাকেন। রাজনৈতিক নেতা এবং সেনাপতি হয়ে থাকেন এইরূপ ব্যক্তিরা। স্বভাবে এঁরা দাম্ভিক এবং অসহিষ্ণু হন। এই গ্রন্থি বিশৃঙ্খল হলে মানব অসংযমী, অহংকারী এবং কামুক হয়। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আহারে অসংযম। সেইজন্য এরা সচরাচর পেটের রোগে ভুগে থাকে ।
এবার ঐ মণিপুর চক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি। মণিপুর চক্র নাভিমূলে অবস্থিত । দশ-দলবিশিষ্ট গাঢ় মেঘতুল্য নীলবর্ণবৎ এই মণিপুর পদ্ম। এই পদ্মের দশটি দলে অনুস্বারবিশিষ্ট দশটি অগ্নিবর্ণ অক্ষর সন্নিবিষ্ট রয়েছে, এইগুলি যথাক্রমে – ডং, ঢং, ণং, তং, থং, দং, ধং, নং, পং, ফং । এই মণিপুর পদ্মের অভ্যন্তরে প্রভাত সূর্যের মতো দীপ্তিশালী ত্রিকোণ অগ্নিমণ্ডল বিদ্যমান। তার তিন বাহুতে স্বস্তিকচিহ্ন শোভিত রয়েছে এবং ত্রিকোণ মধ্যে অগ্নিবীজ ‘রং’ বিদ্যমান। ঐ অগ্নিবীজ মেষারূঢ় নবীন সূর্যবৎ চতুর্ভুজ। আবার ঐ বীজের ক্রোড়ে বিশুদ্ধ সিন্দুরবর্ণবৎ ভস্মলিপ্তদেহ বৃদ্ধরূপী বৃষারূঢ় ত্রিনয়ন রুদ্রমূর্তি মহাকাল বিরাজমান। ঐ পদ্মের কর্ণিকা অভ্যন্তরে রক্তপদ্মোপরি শ্যামা পীতাম্বর-পরিহিতা ঘোরদ্রষ্টা মত্তচিত্তা লাকিনীশক্তি বিরাজমান । ইনি চতুভুজা। বর, অভয়, বজ্র ও শক্তি এঁর চারহস্তে শোভা পাচ্ছে।
প্রশ্ন—এখন আপনার মুখ হতে অনাহত চক্র সম্পর্কে কিছু শুনবার বিশেষ আগ্রহ হচ্ছে। কৃপা করে আপনি ঐ সম্পর্কে বলুন।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, অনাহত চক্র বা বায়ুগ্রন্থি বক্ষ প্রদেশেই। বায়ুগ্রন্থি দেহের প্রধান কর্মক্ষেত্র। এই বায়ুই শরীরের প্রধান রক্ষক এবং পরিচালক। এটা দেহের সর্বাপেক্ষা দায়িত্বশীল গ্রন্থি।
এই গ্রন্থি প্রধান ব্যক্তিরা ধীর, স্থির এবং সংযমী হন। এঁরা মনসংযমী ও আত্মসংযমী হন। সমাজে এঁরা হন খুব শ্রদ্ধার পাত্র। এই গ্রন্থি বিশৃঙ্খল হলে মানব অস্থিরমতি, প্রলাপী, অকৃতজ্ঞ ও বিক্ষিপ্ত হয়।
এখন অনাহত চক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি। হৃদয়দেশে বকফুলের ন্যায় লোহিতবর্ণ দ্বাদশ দলবিশিষ্ট অনাহত পদ্ম বিরাজমান । দ্বাদশ দলে অনুস্বারযুক্ত সিন্দুরবর্ণ দ্বাদশটি অক্ষর সন্নিবিষ্ট রয়েছে। এইগুলি যথাক্রমে- কং, খং,গং, ঘং, ঙং, চং, ছং, জং, ঝং,ঞং, টং এবং ঠং। এই পদ্মের অভ্যন্তরে ধূম্রবর্ণ ষটকোণ বায়ুমণ্ডল শোভিত রয়েছে। আবার বায়ুমণ্ডলের ওপরে ত্রিকোণযুক্ত বিদ্যুৎ-প্রভাময় সূর্যমণ্ডল অবস্থিত। ঐ ষটকোণ মধ্যে বায়ুবীজ ‘যং’ বিদ্যমান। এই বায়ুবীজ কৃষ্ণসারারূঢ় ধুম্রবর্ণ, মাধুর্যময় এবং চতুর্ভুজ। ঐ বীজের ক্রোড়ে বরাভয় মুদ্রা দ্বিভুজ ত্রিনেত্র ঈশান বিরাজমান। ঐ পদ্মের কর্ণিকা অভ্যন্তরে পীতবর্ণা নানা অলংকার-বিভূষিতা আনন্দ-উন্মত্তা রসাভিসিক্তহৃদয়া চতুর্ভুজা কাকিনীশক্তি বিরাজিত। ইনি কংকাল এবং মালাধারিণী। ষকোণের ঊর্ধ্বে যে ত্রিকোণ রয়েছে তার অভ্যন্তরে কাঞ্চনবর্ণ এবং উজ্জ্বল মস্তকে অর্ধচন্দ্র শোভিত বাণ নামক শিবলিঙ্গ বিরাজমান । এখানে কোটী বিদ্যুৎপ্রভা সমতুল্য কোমলাঙ্গী ত্রিনেত্রা নাম্নী শক্তি বিরাজমান রয়েছেন। একে বলা হয় বিষ্ণুগ্রন্থি।
আজ এই পর্যন্ত থাক্, পরে বাকী গ্রন্থিগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা যাবে।