প্রিয় আত্মন্‌—

এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় হল ‘শব্দ উপাসনা’ বা ‘নাম উপাসনা’। শব্দের উৎপত্তি ও শব্দের তাৎপর্য নিয়ে কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন । চৈতন্য হল মহাকারণ, আদি পরাশক্তি বা ব্রহ্মশক্তি। ঐ পরাবাক্-রূপ আদিশক্তি বিশ্বচরাচরে—সর্বভূতে বিদ্যমান । বিশ্বসংসাররূপে সমস্ত কিছুই ঐ মহাশক্তির স্বরূপ বা পরিণাম । এই বিশ্বসংসার প্রকাশ হওয়ার পূর্বে অস্ফুটভাবে পরাবায়-কারণরূপে বিদ্যমান থাকে । অস্ফুট অবস্হা হতে স্ফুট অবস্হায় প্রকাশিত হয় সৃষ্টি, স্হিতি ও প্রলয়ের মাধ্যমে। এই ব্যক্ত শক্তিই ঈশ্বর, হিরণ্যগর্ভ ও বিরাটরূপে প্রকাশিত। মহাকারণ অবস্হা হতে স্ফুট ব্রহ্ম বা প্রণব অভিব্যক্ত হয়ে স্থূল বিশ্ব-সংসাররূপে প্রতিভাত—এটাই হল শব্দব্রহ্ম বা প্রণবতত্ত্ব। উপনিষদে এটা উদ্‌গীত নামে কথিত। এই শব্দ হতেই মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্তাদি-অন্তঃকরণ, পঞ্চতন্মাত্রা, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চভূত ও পঞ্চপ্রাণ সংযোগে বা সহযোগে এই স্থূল, সীমিত, খণ্ডিত, দৃশ্যমান জগৎ প্রতিভাসিত হচ্ছে । ঐ পরাবায় চৈতন্যই চিত্ত, মন, বুদ্ধি ও অহংকাররূপ অন্তঃকরণের কারণস্বরূপ। পঞ্চভূত এবং পঞ্চপ্রাণেন্দ্রিয় সকলের মধ্যে শব্দের সূক্ষ্মশক্তি প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান। সূক্ষ্ম আকাশতত্ত্ব ও সূক্ষ্ম বায়ুতত্ত্বের সংযোগে এটা স্থূল শব্দরূপে মানবদেহের কণ্ঠে প্রকাশিত। সেইহেতু শব্দের ঐ সূক্ষ্মশক্তি মানবজীবনের সমস্ত কিছুর ভিতর এবং বাইরের সর্বত্র ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান । এই শব্দের মাধ্যমে মহাকারণরূপ পরাবায় অনাদি চৈতন্যের অনুভব হয়ে থাকে । এই স্থূল শব্দকে ‘মন্ত্র’ বলা হয় । চৈতন্যযুক্ত শব্দই মন্ত্ৰ । ঐ পরাবায় আদি শব্দই বিশ্বের সুর বা আদি কারণ। আর ঐ উদ্‌গীতই সমস্ত জীব-জগতের সুর ও ভাষারূপে প্রকাশিত। চৈতন্যময় পরাবাক শব্দই সমগ্ৰ বিশ্বের মূল আধার । ঐ পরাবায় শব্দই বেদের উদ্‌গীত বা প্রণব। ব্যাকরণগত ‘প্রণব’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে—প্র—নু + অ (ণে); ‘প্রকর্ষণ নিয়তে,স্তুয়তে অনেন ইতি প্রণব’—অর্থাৎ যার দ্বারা প্রকর্ষণের সঙ্গে বিশেষরূপে স্তবন করা যায়—তাই প্রণব। পরমেশ্বরের প্রকাশ এই বিশ্বসংসার। আদি পরাবাক্ ধ্বনি প্রথম উদগীত হয় পরমাত্মা হতে। সেইজন্য পরমেশ্বরের বচনই হল প্রণব। পরমাত্মা অনামী, তা হলেও স্থূলজগৎ প্রকাশের পূর্বে পরাবারূপ আদি ধ্বনিতে এর প্রথম প্রকাশ। তাই অনামী হয়েও তার নাম আছে আর সে নাম প্রথম প্রণবরূপ। যা জড় বা বিশ্বরূপে আমারা দেখছি, তা পরমেশ্বরের চৈতন্যময়তারই প্রকাশ । পদার্থের অতি ক্ষুদ্র অণুকণাগুলি বৃহৎ শক্তিতরঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কণাগুলি অপরিমেয় শক্তিতরঙ্গে মিশে শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আবার কণিকায় পরিণত হচ্ছে। এইভাবে অনন্ত নীহারিকাপুঞ্জ-বিশ্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে রূপান্তরের কাজ চলছে। অনাদিকাল হতে প্রণব জড়জগৎ বা বিশ্বরূপে প্রকাশ হচ্ছে। সাধারণত সকলে প্ৰণব’ কে বুঝে থাকেন বা বুঝাতে থাকেন এরূপে যে—প্রণব–‘অ’, ‘উ’, ও ‘ম’- এর সমষ্টি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ইত্যাদি নানারকম ভাবেও অনেকে এর বিশ্লেষণ করে থাকেন । বাস্তবিক একে ব্যাকরণের দ্বারা বিশ্লেষণ করা যায় না। স্বরূপত এ এমন এক ধ্বনি যা সম্পূর্ণ যোগলব্ধ। যোগী বা সাধক ভিন্ন অন্য কেউ এটা অনুভব করতে পারে না। একমাত্র যোগলব্ধ আত্ম-অনুভূতির দ্বারা প্রত্যেকেরই এটা বোধ হতে পারে । বাক্য দ্বারা এই প্রণবধ্বনিকে প্রকাশ করা যায় না, লিখে ও সংকেত দ্বারাও এ অব্যক্ত থাকে। কারণ এ বর্ণাত্মক ধ্বনি নয় বা কোন ভৌতিক পদার্থের সংঘাতসৃষ্ট কোন ধ্বনি নয়। এ একান্ত যোগলব্ধ পরম অনুভূতি। সুতরাং প্রণব হচ্ছে চিন্ময় আর যিনি এই প্ৰণব অনুভব করেন, তিনিও চিন্ময়।

প্রিয় আত্মন্‌, আমরা আবার পূর্বের আলোচনায় ফিরে আসছি— আলোচনার দ্বারা এটাই নিশ্চিত হওয়া গেল যে, ঐ পরাবাক্ আদি-শব্দই বোধ, ইচ্ছা ও ক্রিয়া—এই ত্রিগুণ আশ্রয়ে বিশ্বজগতের যাবতীয় প্রকাশের কারণ। সেহেতু চৈতন্যময় ধ্বনি (পরাবাক্ বা উদ্‌গীত) বিশ্ব-সংসারের সার বা মূল। প্রণব ঐ মহাশক্তি বা মহাকাল। স্থূলদেশে ছন্দোবদ্ধ সুর ও ভাষারূপে প্রকাশিত। এই প্রণবের ব্যক্ত গতিশীলতার যে অবস্হা, তাই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃগুণের প্রবাহ দ্বারা বিশ্ব-চরাচরে চঞ্চলভাবে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু সর্বতোভাবে এই আবর্তের ঊর্ধ্বে ব্রহ্ম বা পরতত্ত্ব(সম্পূর্ণ তত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব)—নিস্তরঙ্গ গুণাতীত অখণ্ড সত্তা। এই ব্যক্ত চরাচর বিশ্ব- সংসার ব্যক্তশব্দ শক্তির গুণের দ্বারা সীমিত। সেইজন্য কারণময় মহাশক্তির পরিণাম হল জগৎ। পরাবায় চৈতন্য ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, স্হিতি ও প্রলয়রূপ গুণময় লীলা বা ক্রিয়াশীলতা। তাই পরাবাকের অবরোহ গতিই হল বিশ্বসৃষ্টি যা পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা ও বৈখরীরূপে প্রকাশিত বা প্রতিভাত। আর ঐ পরাবাকের আরোহ গতিই হল প্রলয়-যা বৈখরী, মধ্যমা, পশ্যন্তি হয়ে পরাবাকে বিলীন হয়ে যায়।

প্রিয় আত্মন্‌, শব্দের এই যে আরোহ ক্রমগতি—এটাই হল নাম উপাসনা বা শব্দ উপাসনার রহস্য। এই প্রণব-উপাসনা—শব্দ সাধনা, নাম সাধনা প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দেশ, কাল ও পাত্রে প্রচারিত।

বিশ্ব-চরাচর ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে আমাদের দেহরূপ এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড একই সূত্রে ওতপ্রোত। এই দেহরূপ ব্রহ্মাণ্ডেও ঐরূপ পরাবায় শব্দের রহস্যময় অবরোহক্রম ও আরোহক্রম গতিশীলতা বিরাজমান বা বিদ্যমান।

দেহভাণ্ডে ইড়া, পিঙ্গলার মাধ্যমে ঐ অবরোহ গতি ক্রিয়াশীল প্রতিটি মানবে। আরোহ-ক্রম গতি সুষুম্না নাড়ীকে মাধ্যম করে ক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু সাধারণত প্রত্যেক দেহে এই নাড়ী সুপ্ত অবস্হায় বিদ্যমান, অর্থাৎ ক্রিয়াশীল থাকে না। সদগুরুর সংস্পর্শে ও সাধনায় এর উন্মেষ ঘটে থাকে এবং সুপ্ত স্তরগুলি ক্রিয়াশীল হয়। মানব তখন আরোহক্রম গতি দ্বারা পরম স্থিতিলাভ করে এবং পরাবাকময় পরম চৈতন্যরূপ ঈশ্বরকে বোধ করে। এই পরাবাকময় প্রণবরূপ ঈশ্বর অন্তঃকরণ দ্বারা পূর্ণ অনুভবগম্য এবং নামসাধনা বা শব্দ সাধনার দ্বারা লভ্য। যা গুণতীত তত্ত্ব এবং নিস্ত্রেগুণা-তা বাক্য, মন, বুদ্ধি ও অহংকারের অতীত। এই তত্ত্বকে মানব নির্বিকল্প সমাধি দ্বারা বোধে বোধ করতে পারলেও বিশ্বে সংবাদ দেবার ব্যক্তিত্ব তার থাকে না। তা কেবল বোধে বোধ হয়। যার লাভে অলভ্য কিছু থাকে না, যার বোধে সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার সমাপ্তি তাই অমৃততত্ত্ব। তুমি অমৃতের, অমৃত তোমার। তুমি অমৃতস্বরূপ।- ‘তত্ত্বমসি’।

প্রিয় আত্মন্‌-আমরা এতক্ষণ শব্দ উপাসনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করলাম। এইবার আমরা বর্তমান সমাজে ঐ শব্দ বা নাম উপাসনাকে কেন্দ্র করে কিরূপ প্রতিক্রিয়া চলছে—সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করব।

কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বলে থাকেন—কলিকালে তারকব্রহ্ম নাম ছাড়া কারও গতি নেই বা মুক্তি নেই। এইরূপ আপন আপন সম্প্রদায়ের কোন বিশেষ নাম বা শব্দকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁরা বলেন- এটাই তারক এবং মুক্তি প্রদায়ক। আর অন্য যে সমস্ত নাম বা শব্দ নিয়ে যাঁরা উপাসনা করছেন, তাঁদের উপাসনা ভস্মে ঘৃতাহুতি তুল্য। এইরপভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায় আপন আপন সাম্প্রদায়িক বিশেষ নাম বা শব্দকে কেন্দ্র করে বিবাদ করতে থাকেন এবং আপন সাম্প্রদায়িক বিশেষ নামকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ও অপর সম্প্রদায়ের বিশেষ নামকে হেয় বা নিষ্ফল প্রতিপন্ন করবার জন্য নানাপ্রকার শাস্ত্র, পুঁথি, ইতিহাস ইত্যাদি দ্বারা প্রমাণ সংগ্রহ করে কলহ ও তর্ক করে থাকেন।

প্রিয় আত্মন্‌, সমাজে কত প্রকারের কুসংস্কার শিকড় গেড়ে আছে আর মানব দিনে দিনে নানাভাবে সেগুলোতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং অপরকেও বিভ্রান্ত করছেন । শব্দ-উপাসনার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে তাঁদের কুসংস্কারগ্রস্ত মন উপলক্ষ্যকে প্রধান ভেবে লক্ষ্যচ্যুত বা কক্ষচ্যুত অবস্হা লাভ করছে এবং লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর না হয়ে উপলক্ষ্যে আটকে গেছে। তাঁরা বলতে থাকেন— “আমাদের এই নামই একমাত্র ঈশ্বরের নাম আর এই নামেই একমাত্র ভজনা হয়, অন্য নামে তাঁর ভজনা হয় না”। কি ভয়ংকর অজ্ঞতা ! অর্বাচীন লোকের এরূপ বাক্য মানবকে বিভ্রান্ত করে। তাঁরা আরো বলে থাকেন—তাঁদের সম্প্রদায়ের নাম ছাড়া অন্য নামে তাঁকে ডাকলে তাঁর সাড়া পাওয়া যাবে না। এক ঐ নামে তাঁকে উপাসনা করা ছাড়া অন্য নামে তাঁর আরাধনা করা উচিত নয়। কিন্তু ভাবগ্রাহী ভগবান সর্বভাবেই সাড়া দেন। তিনি প্রাণের আবেগ ও মনের আকুল প্রার্থনায় সব সময় সাড়া দেন।

প্রিয় আত্মন্‌—তুমি নিজ ভাব অনুযায়ী তোমার প্রিয় নামটি আশ্রয় কর এবং সেই ভাব সহযোগে নামের দ্বারা তাঁকে অকপটভাবে ভজনা কর। কারও প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ো না। তাঁর নাম কি কেবল একটি, আর কিছু নয় ! এই অনন্ত বিশ্ব যাঁর প্রকাশ, তিনি কি কোন নামে আবদ্ধ ! তোমার যে নামটিতে নিষ্ঠা, তুমি সেই নামটিকে আশ্রয় কর। তিনি একই তত্ত্ব। নাম পরিবর্তন করলে কি তত্ত্বের পরিবর্তন হয় ? অজ্ঞানী ভ্রান্ত ব্যক্তিরাই নাম নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ ও কলহ করে। তুমি তত্ত্বমুখী হও। তুমি তোমার প্রিয় আকাঙ্ক্ষিত নামটি গ্রহণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে ভজনা করতে থাক। তুমি তাঁকেই পূর্ণরূপে বোধ করবে। তিনি পরমতত্ত্ব, অভেদ, অবিভক্ত—একরস তত্ত্ব। নাম পরিবর্তনে তত্ত্ববস্তুর পরিবর্তন হয় না। যিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন- সেই নিত্যতত্ত্ব—তাঁর কোন বিশেষ নাম নেই। তুমি তোমার মনোমত যে কোন নামে তাঁকে ডাকতে থাক। নিষ্কপট হয়ে নিষ্ঠা ও ভালবাসার অনুরাগে অনুরণিত হয়ে আকুলতার আবেগে তাঁর অভাববোধ করতে থাক। তোমার ঐ অভাবজনিত বেদনা মূর্ত হয়ে উঠুক জীবনরূপ একতারার সুষুম্নারূপ তারটিতে। আর তাঁর অভাবে তোমার জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে উঠুক। ঐ পিপাসাতেই তোমার একতারার তারে ঝঙ্কার উঠবে আর তোমার অন্তর্দেশে বোধির দ্বার খুলে যাবে, বিমল জ্যোতি উদ্ভাসিত হবে অন্তর্দেশ-মুখে। সমস্ত অন্ধকার চকিতে বিদূরিত হবে আর মূর্ত হয়ে উঠবে তোমার চিরবাঞ্ছিত, চির আকাঙ্ক্ষিত সেই তত্ত্ব। যাঁর আবির্ভাব তোমাকে পূর্ণতার বোধে উপনীত করাবে। তুমি আত্ম-বোধের স্হিতি লাভ করবে।

প্রিয় আত্মন্—তুমি পূর্ব হতেই পূর্ণ, এটা তোমার বোধ ছিল না, বোধ উদয়ে তুমি তা প্রত্যক্ষ করলে মাত্র। তোমার ভিতরে, বাইরে, সর্বত্র, সর্বভূতে, সর্বনামে—তাঁরই প্রকাশ। আবার সমস্তের মধ্যে তিনি বিরাজমান। একমাত্র তিনি । শুধু তিনি । শুধু তিনি ! শুধু তিনি । তিনি বা সেই তত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি ছাড়া আর যা আছে তা একমাত্র অজ্ঞানতা। আর এই ভ্রম বা অজ্ঞানতার কারণবশত তুমি ভেদবুদ্ধি নিয়ে বিবাদ করছিলে, অস্হির হয়ে শোক করছিলে। এখন ভ্রান্তি বা অজ্ঞানতা মুক্ত হয়ে সমরস পরমতত্ত্ব বোধের উদয় হয়েছে। তুমি সহজ হয়েছ। তুমি স্ব-স্বরূপে পরমানন্দে বা সহজানন্দের অনাবিল উল্লাসে মগ্ন বা সমাহিত। তুমি তত্ত্বস্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ, দ্রষ্টামাত্র। “তত্ত্বমসি’।

প্রিয় আত্মন্‌—উদ্দনিষদ প্রতিপাদ্য ঐ আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব যোগলব্ধ বা সমাধিলব্ধ অর্থাৎ একমাত্র সমাধি দ্বারা তা বোধিতব্য। পার্থিব মন, বুদ্ধি, অহংকারের অতীত, তকতা, অমৃতময় এই আত্মতত্ত্ব। এই তত্ত্ব আকাশকুসুম প্রসূত সৃষ্ট গল্প নয় বা কল্পনাসৃষ্ট পৌরাণিক কাহিনীও নয়। আবার ঝাড়ফুঁক, তুক -তাক, যাদুমন্ত্রও নয়। এটা হল তত্ত্বচিন্তার পরিণতি সম্পূর্ণতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব। বর্তমানে ভারতে এবং বহির্ভারতে মানব-সাধারণ বহু বিশিষ্ট দেবদেবীর উপাসনা করে থাকেন, কিন্তু বহু ঈশ্বর কখনই নন। পাশ্চাত্যের কেউ কেউ ভেবে থাকেন—ভারতবর্ষের হিন্দুরা বহু ঈশ্বরবাদী এবং অসংখ্য ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে উপাসনা বা অর্চনা করেন। কিন্তু এরূপ উক্তি তাঁদের ভ্রান্তিরই পরিচয় দেয়। অর্থাৎ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা এরূপ বলে থাকেন। আসলে যে কোন নাম এবং রূপ দ্বারা তাঁকে উপাসনা বা অর্চনা করা হোক না কেন, সকল নাম বা রূপই তাঁর বিভূতি বা প্রকাশ । সেইহেতু যে কোন নাম বা রূপসহকারে তাঁর অর্চনা করা হোক না কেন, স্বরূপত সেই একই পরমেশ্বরকে উপাসনা করা হবে। এই পরমেশ্বর হলেন সগুণ ব্রহ্ম — ইনিই উপাস্য। যে কোন সম্প্রদায়—যে কোন আচার ও অনুষ্ঠান সহকারে ও বিভিন্ন উপাচারে ঐ সগুণ ব্রহ্মরূপ পরমেশ্বরের উপাসনা করতে পারে। সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশ, কাল ও পাত্র বিশেষে যে কোন আচার বা অনুষ্ঠানগত বৈচিত্র্য থাকলেও পরম তত্ত্বে কোন ভেদ বা বিরোধ নেই। সুতরাং সমস্ত সংসারে যত প্রকারের উপাসনা বিরাজমান তা সবই নাম-রূপাত্মক, শুধু পার্থক্য আচার-অনুষ্ঠানগত যে কোন নাম-রূপ সহায়ে অর্চনা করলে তাঁরই উপাসনা হয়। সেইহেতু উপাসনায় বৈচিত্র্য আছে কিন্তু বিরোধ নেই। এই গভীর রহস্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুভূতির পূর্ণ বোধ না হলে সংসারের বিরোধ বা কলহ মিটবে না। একমাত্র তখনই বিবাদ বা কলহ সমাপ্ত হবে, যখন অখণ্ড অধ্যাত্ম চেতনার অপরোক্ষ অনুভূতি হবে। স্বার্থচেতনা, শ্রেণীচেতনা, গোষ্ঠীচেতনা, সাম্প্রদায়িক চেতনা সেদিন বিলুপ্ত হবে—যেদিন মানবের অধ্যাত্মমানস উন্মেষিত হবে এবং অখণ্ড বোধে বোধ হবে।

প্রিয় আত্মন্—অজ্ঞানতায় বা ভ্রান্তিবশত শোক করো না। আত্মসচেতন হও। আত্মবিস্মৃত ভাব হতে উন্নীত হও। অজ্ঞানতা ও ভ্রান্তি হতে মুক্ত হও। তমসাচ্ছন্ন আবেশ কাটিয়ে ওঠ। তুমি নিত্যমুক্ত। তোমার নতুন কোন মুক্তির সম্ভাবনা কোথায় ! একমাত্র ভ্রান্তির কারণ—বন্ধন কল্পনা। সত্ত্বর অবিদ্যার অজ্ঞানতা হতে মুক্ত হও। ত্রিগুণাতীত, অচিন্ত্য, অমৃততত্ত্বকে অনুভব কর। যা একমাত্র যোগলব্ধ সমাধি দ্বারা বোধে বোধ হবে।

‘তত্ত্বমসি’।

আনন্দ প্রতিষ্ঠিত। পরমেশ্বরের করুণা অপার।