🕉️

পরমানন্দ মিশন

গ্রাম+পোঃ-বনগ্রাম, জেলা-বৰ্দ্ধমান(পঃ বঃ )

                                                               পিন-৭১৩৪০৭

                                                             চরৈবেতি কার্যালয়

মুখবন্ধ

পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দজীর বাংলা ভাষায় রচিতদ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বাউলের মর্মকথা’ প্রকাশিত হল । এই গ্রন্থের সূচনাংশটিইতিপূর্বে ‘পরমানন্দ মিশন’ হতে প্রকাশিত ‘চরৈবেতি’ পত্রিকাতে“বাউলের মর্মকথা’ নামে ছোট প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।প্রবন্ধটি পাঠ পূর্বক পাঠকবর্গ বিশেষভাবে মুগ্ধ হন এবং ‘বাউল’ সম্পর্কেবিস্তৃতভাবে জানবার আগ্রহ প্রকাশ করেনলেখকের সকাশে।পাঠকবর্গের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাঁদের জ্ঞাতার্থে লেখক ‘বাউলেরমর্মকথা’ নামক বর্তমান গ্রন্থটি রচনা করেন।

গ্রন্থটির মধ্যে বাউলদের সম্পর্কেই একটা সামগ্রিক আলোচনা থাকলেও বিভিন্ন জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে ও পাঠকগণের বোধের সুবিধার্থে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়গুলিকে নিয়ে গ্রন্থটিকে পরিশিষ্ট ছাড়া নয়টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য গ্রন্থটি আলোচনাকারে ব্যক্ত হওয়াই কিছু কিছু বিষয়ের কিছু কিছু অংশ আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বিষয়ান্তরে উপস্থিত হয়েছে, তবে এর ফলে পাঠকের রসবোধের কোন প্রকার হানি হবে বলে মনে হয় না, বরং উক্ত বিষয় তথা প্রসঙ্গের কথা পুনঃ স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে পাঠকগণ সমগ্র আলোচনার মধ্যে একটা সামঞ্জস্যবোধ ও ধারাবাহিকতা খুজে পেয়ে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারবেন ।

লেখক এই ছোট পুস্তকটির মধ্যে ‘বাউল’ শব্দের তাৎপর্য, বাউলদের উৎপত্তি, বাউল তত্ত্বের রহস্য তথা মানুষতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, আদিরস বা কামতত্ত্ব, বাউলদের রাগমার্গের সাধনা ও সাধন-পদ্ধতির গুহা রহস্য,বিশেষ করে তাঁদের প্রেমতত্ত্বের অতি অপূর্ব মনোরম বিশ্লেষণ, তাঁদের বেশভূষার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, সাধনায় সঙ্গীত ও নারীর অনবদ্য ভূমিকা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন । অতি দুরূহ ও গোপন তত্ত্ব, যা ইতিপূর্বে কোন গ্রন্থে এত পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি—মানুষের নিকট যা ছিল রহস্যাবৃত, লেখক বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে, সরল ও সাবলীল ভঙ্গীতে, দরদী মন নিয়ে, বোধির দৃষ্টিতে ও প্রাণোচ্ছল ভাষায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন।

লক্ষ্য করার বিষয়, লেখক আলোচনাংশের অনেক স্থলে বাউলগণেরই মতামত বা বক্তব্য তুলে ধরে ও তাঁদের সমস্ত কিছু নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করে এবং অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধনার সঙ্গে সামঞ্জস্য দেখিয়ে দ্রষ্টাবৎ অবস্থান করেছেন।

বলাবাহুল্য পরিশিষ্টের মধ্যে লেখকের স্বরচিত বাউল-কবিতাগুচ্ছ সংযোজিত হওয়াই গ্রন্থটির সৌন্দর্য অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে। বাউলের মর্মকথা অভিনবভাবে কাব্যিক রূপ লাভ করায় রসিক পাঠকগণের নিকট এটা পরম আস্বাদনীয় হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

পরিশেষে বলা যায়—গ্রন্থটি পাঠ করে শুধু যে বাউল সাধকগণই বিশেষভাবে উপকৃত হবেন তা নয়, পক্ষান্তরে সকল শ্রেণীর পাঠক তথা আধ্যাত্মিক রসপিপাসু ব্যক্তিগণ ‘বাউল’ সম্পর্কে একটা ব্যাপক স্বচ্ছ ধারণা ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা সমন্বিতভাব লাভ করে এক দিব্য বা নির্মল রস আস্বাদন করতেও সক্ষম হবেন বলে মনে করি ।

অলমিতি

     —প্রকাশক

সূচীপত্র

   বিষয়                                                                              পৃষ্ঠা নং—

সূচনা

প্রথম পরিচ্ছেদ (‘বাউল’ শব্দের তাৎপর্য, বাউলের পরিচয়-তত্ত্ব, সহজিয়া বাউলগণের উৎপত্তি ইত্যাদি )  

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ( বাউল তত্ত্বের রহস্য )

তৃতীয় পরিচ্ছেদ ( বাউলের দেহতত্ত্ব )

চতুর্থ পরিচ্ছেদ (বাউলের আদিরস বা কামতত্ত্ব )

পঞ্চম পরিচ্ছেদ (বাউলদের বিভিন্ন ধারা, মধুর ভাব,অভাব, স্বভাব ও মহাভাব তত্ত্ব )                            

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ( বর্তমান বাউলগণের সাধনা ও তাঁদের মতামত )

সপ্তম পরিচ্ছেদ ( বাউলদের সহজিয়া রাগমার্গের বর্তমান ভজন সম্পর্কিত আলোচনা )

অষ্টম পরিচ্ছেদ ( শক্তি ও শক্তিমান তত্ত্ব, স্বরূপশক্তি তথা শক্তিত্রয়ের বিবরণ এবং অভাব হতে মহাভাবে উত্তরণের পন্থা ও পদ্ধতি)

নবম পরিচ্ছেদ ( বাউলের প্রেমতত্ত্ব )

পরিশিষ্ট  ( কবিতাগুচ্ছ)

-: সূচনা :-

প্রিয় আত্মন্‌—

বেদ ও উপনিষদের মর্মবাণীর মধ্যে ভারতের শাশ্বত সনাতন ধর্মের ভাবটি বিদ্যমান। এই উপনিষদ-ভিত্তিক ‘ব্রহ্মতত্ত্ব’ বা ‘আত্মতত্ত্ব’ই হল বেদের সার। এই ‘আত্মতত্ত্বে’র আলোচনামূলক গ্রন্থই ‘বেদান্ত’ ।

ঔপনিষদিক ধারা বা বেদান্ত প্রতিপাদ্য ‘আত্মতত্ত্ব’—এই সংস্কৃতির ভাবধারা আজও বহন করে চলেছেন বাউল সন্ন্যাসীরা। বাউল সেই বেদান্ত- উপনিষদ প্রতিপাদ্য আত্মতত্ত্বের অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়েন ঘর ছেড়ে কোথায় তাঁর সেই ‘মনের মানুষ’ বা দেহাতীত আত্মতত্ত্ব ? উন্মুখ হয়ে ঘুরতে থাকেন দেশ হতে দেশান্তরে। তাঁর বাউগুলে বিবাগী মন খুঁজতে থাকে সেই নিত্য শাশ্বত অবিনশ্বর বেদপুরুষ আত্মতত্ত্বকে। তাঁর বৈরাগ্যবিধুর বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে অনুরাগে – “কোথায় পাবো তাঁরে, আমার মনের মানুষ যেরে অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর চির আকাঙ্ক্ষিত সেই ‘মনের মানুষ’কে।

এই বিরাট বিশ্বসংসাররূপে যাঁর স্বতঃপ্রকাশ, সেই তত্ত্বই তাঁর ভেতর প্রকাশ। সীমার ভেতর তিনি বোধেবোধ করেন সীমাহীনকে। অসীমের সীমাধারণ আর সীমার অভিব্যক্তি অসীমের প্রতি। সবই প্রেমময় পরমেশ্বরের লীলা- সবই তাঁর প্রকাশ।

বাউল জীবনের ভেতর সেই পরমতত্ত্বকে অপরোক্ষ অনুভব করেন। তিনি দেহভাণ্ডেই ব্রহ্মণ্ডের বোধেবোধ করেন।

জীবন পরমেশ্বরেরই প্রকাশ । তারই জীবনরূপী লীলা চলছে। সেই এক তত্ত্বই বহু নাম-রূপ ধারণ করে লীলা করতেন। এই লীলার আধার আনন্দ আর আনন্দের আধার প্রেম। এই বিশ্বসংসার তাঁর প্রেমময় প্রকাশ । এই ‘অনন্ত প্রেমতত্ত্বে তাঁর আনন্দময় লীলা চলছে। সমস্ত কিছুর ভেতরই তিনি বিরাজমান বা সমস্ত কিছুতেই ভাসমান । এককথায় তিনি সবেতে ; সব তাঁতে—তিনি ছাড়া কিছু নেই ওতঃপ্রোত অখণ্ড । তিনি নিত্যশাশ্বত – সনাতন। তিনিই আত্মতত্ত্ব বা ব্ৰহ্মতত্ত্ব। অজ্ঞানই শুধু অনিত্য। অবিদ্যা আচ্ছন্ন জীব তা উপলব্ধি করতে পারছে না। কারণ সে অসহজ, অবিদ্যাগ্রস্ত – ‘মনের মানুষ’কে ভুলেছে। সেইজন্য তার এত দুঃখ-কষ্ট, শোক ও হাহাকার । *মনের মানুষ’কে না জেনে তার জীবন বিষময় হয়ে পড়েছে। অসহজ ও কপট ভাবের হেতু সে যে অমৃতস্বরূপ —এটা তার বোধ নেই। তাই শোকার্ত হয়ে বিষময় জীবন-যাপন করছে। আত্মবিস্তৃত, আত্মজ্ঞান-রহিত, ‘অবিদ্যাগ্রস্ত, অজ্ঞান জীবই অসহজ। সেজন্যই সে শোক করছে। আর আত্ম-সচেতন, অবিদ্যা-অজ্ঞানমুক্ত আত্মতত্ত্ববিদ ব্রহ্মজ্ঞই আত্মস্বরূপ, আত্মজ্ঞ বা সহজ ।

উপনিষদের এই মর্মবাণীকে আপনার জীবনে বোধেবোধ করে – সেই বোধিকে সহজ ভাষায় গান রচনা করে গেয়ে বেড়ান বাউল গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, নগরে মানুষের দ্বারে দ্বারে । এঁরা সাক্ষাৎ জীবনের পূজারী –অভিনয়ের পুজারী নন।

‘বাউল’ কোন সম্প্রদায় নয় বা বাদগ্রস্ত দলও নয়। বাউল বোধির দ্বারা অভিভূত পরম আত্মতত্ত্বকে সহজ ভাষায় প্রচার করেন। বাউলের প্রচারিত জীবনবাদ – ধর্ম। জীবনকে বাদ দিয়ে ধর্ম নয় । জীবনের ভেতর দিয়েই তাঁকে অপরোক্ষ অনুভব করতে হবে, জীবনকে নষ্ট করে নয়। জীবন সেই তত্ত্বের প্রকাশ। জীবনের ভেতর দিয়ে সেই তত্ত্বের সাক্ষাৎকার – এটাই জীবনের রহস্য। এই রহস্য উদ্ঘাটন করে মানবকে সেই পরমতত্ত্ব বা অমৃতস্বরূপ আত্মতত্ত্বকে রোধে বোধ করতে হবে। জীব- নের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সেটাই। তা এইজন্যই বাউল উপনিষদের জীবন্তরূপ সনাতন-ধর্মের বাহক – জীবনের পূজারী বা উপাসক। বাউল উপনিষদের সৃজনমুখী আত্মতত্ত্বেরসাধক ও প্রচারক ৷

বাউলের সম্প্রদায়গত কোন বিবাদ নেই । মতবাদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করেন না বাউল । এঁরা তত্ত্বমুখী বা জীবনমুখী। জীবনবিরোধী অনাত্ম বা অজ্ঞান-অবিদ্যাকে বাউলগণ আশ্রয় করেন না। নিত্য শাশ্বত আত্মতত্ত্বই বাউলের লক্ষ্য। সেই তত্ত্বই নিত্য শাশ্বত আত্মা—জীবন তার প্রকাশ। বাউল বাদ নিয়ে বিবাদ না করে পরমতত্ত্ব বোধের জন্য তৎপর বা উন্মুখ হন। আর সেইজন্যই অনিত্যের প্রতি তাঁর বৈরাগ্য এবং নিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ।

যেখানে সকল বাদই সমাপ্ত, সেখানেই তত্ত্ব’র বোধ। সমস্ত মতবাদের যেখানে পরিসমাপ্তি, সেখানেই প্রকৃত সহজ ধর্মের বোধ। মানব যেদিন বাদমুক্ত হবে সেইদিনই তার আত্মবোধ হবে। তাই বাদের কবলে না পড়ে পরম আত্মবোধের জন্য তৎপর বা অগ্রসর হতে হবে। এটাই প্রকৃত জীবনমুখী ধর্ম। মানুষকে বাদ দিয়ে ধর্মাচরণ নয়, মনুষ্যত্ব লাভ করেই তার ভিতর দিয়ে হয় ধর্মবোধ বা সহজ আত্মবোধ । মনুষ্যত্ব লাভ করাই মানবের প্রথম সাধনা । চরিত্র গঠন বা মনুষ্যত্ব লাভ না হলে আত্মতত্ত্ব বোধ হয় না । সেইজন্য প্রথম চরিত্র গঠন বা মনুষ্যত্বলাভ, তারপর দেবত্ব। আর দেবত্বে উপনীত হলে আত্মতত্ত্ব সহজে বোধেবোধ হয় নি

যাদের মনুষ্যত্ব লাভ হল না তারা কেমন করে উপনীত হবে ? দিয়ে থাকেন। আত্মতত্ত্বে সেইজন্য বাউলগণ মনুষ্যত্ব লাভের উপর বিশেষ জোর আর চরিত্র গঠন হলেই মনুষ্যত্ব লাভ হয়। মনুষ্যত লাভ হলেই নিকপট মানব দেবত্বে উপনীত হন। তখনই মানব সহজ হন এবং তাঁর অন্তর বিকশিত হয়ে উঠে আত্মজ্যোতিতে। তাঁর মধ্যে বইতে থাকে দিব্যচেতনার চিন্তাপ্রবাহ -দিব্যভাবের প্রেমপ্রবাহ ও প্রবল কর্মপ্রবাহ । একাধারে দিব্যজ্ঞান ও অনন্তপ্রেমে প্রবল কর্মের মহাকল্লোল উঠতে থাকে । তিনি বিন্দুর ভেতর দিয়ে সিন্ধুর উল্লাস বোধ করেন। এই সৎ-চিৎ-আনন্দের উল্লাস—পরমানন্দময় সাগরে তিনি নিজেকে দ্রষ্টা- স্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ রূপে জানতে পারেন বা পরমতত্ত্ব বোধে উপনীত হন। আত্ম অনুরাগে, অনাত্ম বৈরাগ্যে, তাই তিনি ‘বাউল’। ঘর ছেড়ে তিনি পথে বের হন ‘মনের মানুষের সন্ধানে। পরম সত্যলাভের জন্য তাঁর বিবাগী মন বাউণ্ডুলে হয়ে ঘোরে পথে, বনে, গিরি-গুহায়, কন্দরে, নগরে, বন্দরে। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন আপনার ভেতরেই আপন মিনের মানুষ’কে। নিজের ভেতরেই সেই পরম আত্মবোধ প্রাপ্ত হন। পূর্ণস্বরূপ আপনাকে আবিষ্কার করেন, যাকে পেলে ‘সব পেয়েছি জাসেই তত্ত্বে উপনীত হন। পেয়েছেন তিনি, তাই ‘পাগল’ অর্থাৎ পেয়ে গিয়েছেন। সেই পরম আত্মতত্ত্ব বোধে বা তত্ত্ববোধে আত্মহারা, তাই তিনি ‘ক্ষ্যাপা’। তাঁর পরম আত্মবোধ, পরমানন্দময় উল্লাস সংগীতাকারে উদ্‌গীত হয়, তাই তিনি ‘বাতুল’। তাঁর অপরোক্ষ অনুভূতআনন্দধ্বনি অভিব্যঞ্জিত হয় অন্তরের সহজ ভাষায় –তাই তিনি উদ্‌গাতা —’বাউল’ বা ‘বাতুল’ ।

পরবর্তীকালে বৌদ্ধতান্ত্রিক, ইসলামিক সুফী ও দক্ষিণের বৈষ্ণব মতবাদের ধারা এসে এই বাউলদের মধ্যে মিশে যায়, ফলে নানা প্রকার মতের সৃষ্টি দেখা যায় বর্তমান বাউলদের মধ্যে। কিন্তু ধর্ম সাধনা জীবনবিরোধী নয় । বর্তমানে যা দেখা যায়, তা জীবনবিরোধী বিকৃত রূপ । দেহ ও মনের বিশুদ্ধতা না হলে অপ্রাকৃত আত্মতত্ত্ব বোধে- বোধ করাই দুরূহ ৷ নিষ্কলুষ ও নিষ্কপট জীবন সাধনায় মানব আত্মতত্ত্বে উপনীত হয়। কামনার পঙ্কিলতায়, ভোগের অন্ধকারে মগ্ন থাকলে পরম আত্মতত্ত্ব বোধেরোধ করা সম্ভব হয় না। বিশুদ্ধ সাধনায় প্রাকৃত পাশ- বিক কামও রূপান্তরিত হয় বিশুদ্ধ পরমপ্রেমে—ভগবৎ প্রেমরূপে। বিশুদ্ধ সাধনাতেই দুর্দান্ত প্রবৃত্তি ও প্রবল বাসনার রূপান্তর ঘটে আত্ম- অনুরাগরূপে, পরম প্রেম ও দিব্যজ্ঞানরূপে।

সাধনার রহস্য হল আত্মস্বরূপ বা আত্মবোধে বোধ হওয়া। জীবন তখন কামগন্ধহীন প্রেমস্বরূপে পরিণত হয়। এই দিব্যপ্রেমই আত্মার প্রকাশ বা ঈশ্বরের মাধুরী। পরমেশ্বরের প্রকাশ এই প্রেমবোধ করাই হল মানব জীবনের চরম ও পরম উদ্দেশ্য ।

বাউলের ‘মনের মানুষ’—তাঁর ভালোবাসার ভগবান সকলের ভেতরই বিরাজমান। মানবের দেবতা মানবের মধ্যেই। মানুষ যখন বাইরে খুঁজতে যায় আপনাকে, তখনই সে আপনাকে পর করে দেয়। আপনাকে মানুষ কামনা-বাসনায়—ভোগের উপকরণে খুঁজতে যায়। আর বাইরের উপকরণে নিজেকে খুঁজতে যায় বলে মানবের এত দুর্দশাভোগ । সেইজন্য মানব অপরের চোখে নিজেকে দেখছে। অপরের ধার করা চোখে নিজেকে দেখছে। নিজের চোখ রয়েছে তথাপি আপনার চোখে সে কিছু দেখছে না। বাইরে তাঁকে খুঁজছে কিন্তু নিজের ভেতরে খুঁজছে না, সেহেতু আবিষ্কারও হয় না। আর এজন্যই বিবাদ, মতবাদ, শোক ও দুঃখ-কষ্ট এবং বিক্ষিপ্ত আপনহারা-মানব মানবের দুর্গতি আপনাকে ভুলে বা আত্মবিস্মৃত হয়ে । আত্মবোধ হারিয়ে অন্তঃকরণে বিকার উপস্থিত হলে আর ‘মনের মানুষে’র অপরোক্ষ অনুভব হয় না। এটাই আত্মবিস্মৃতি বা অসহজতা ।

মানব নিজেকে প্রতিষ্ঠায় বা খ্যাতিতে দেখছে, ভোগের সামগ্রীতে দেখছে কিন্তু নিজেকে নিজের ভেতর দেখছে না। সুতরাং মনের মানুষকে বা আত্মতত্ত্বকে নিজের ভেতরেই আবিষ্কার করতে হবে। যা নিজের ভেতরে-বাইরে নন। তুমি সেই অমৃততত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব। তুমি অমৃতের—অমৃত তোমার। তুমি অমৃতস্বরূপ । ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। তুমি অমৃতের পুত্র ৷ ‘তত্ত্বমসি’।