প্রশ্ন—আপনার নিকট পূর্ব পূর্ব আলোচনার দ্বারা বাউল, বাউলমত তথা বাউলদর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে অপূর্ব ব্যাখ্যা শুনলাম। এতে আমার বাউল সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা হয়েছে, কারণ বাস্তবিক এটা সাধারণের নিকটে রহস্যাবৃত। এখন যদি অনুগ্রহ করে বাউলদের প্রেম সম্পর্কে আরও কিছু আলোকপাত করেন, তাহলে খুবই আনন্দ পাই ৷
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! বাউলদের প্রেম সম্পর্কেই বিশদ আলোচনা করছি, তুমি এই বিষয়ে মনঃসংযোগ কর।
মন হল ইন্দ্রিয় পরিষদের রাজা। সেইহেতু বাসনা বা প্রবৃত্তি দ্বারা মন বশীভূত হলে তখন আর ইন্দ্রিয়গণ স্ববশে থাকে না । সুতরাং মনকে বাসনার শিকার হতে দেওয়া সাধকের কখনই উচিত নয় । মন বাসনামুক্ত হলে চিত্তে প্রেমের অঙ্কুর বা উন্মেষ হয় । বাসনাবিষ্ট মনের বিকারই কাম ।
নির্বিকার অন্তরের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল ভাব। আর ভাব প্রগলভ হয়ে ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করে। সেইজন্য ভাবে-ভরা ভাষাই ভালবাসা ।
বাউল বা বাতুল হলেন প্রেমের উন্মাদ । ব্যক্ত হয় ভগবৎ কথায়—ভগবৎ তাঁর ভগবৎ প্রেম গানে – ভগবৎ নামে ও ভগবৎ চর্চায়। এইজন্য তিনি ভাষামুখর বাতুল বা বাউল ।
বাউলের হৃদয় যেন পদ্মের অন্তরখানি—মধু বা অমৃত যেখানে বিদ্যমান। কিন্তু সে মধু যোগাড় করতে হয় মাধুকরী বৃত্তিতেই ৷
‘বাউলের মৃত্যুঞ্জয় প্রেম
ত্যাগের পাত্রে নিকষিত হেম।’
সুতরাং বাউলমতে কোন আলাদা ধর্ম নেই ৷ মানুষই বাউলদের ধর্ম। সোনার মানুষই তাঁদের জাত । এই মানুষকেই জানতে হবে -মানুষকেই ভালবাসতে হবে। সকল মানুষই তাঁদের আত্মার আত্মা – আত্মীয়, হৃদয়ের হৃদয় – প্রাণের প্রাণ— কেহ পর নয়— সকলেই আপনজন ।
ভালবাসার ধর্মই বাউলদের ধর্ম, সেইজন্য এটা মানবধর্ম । বাউল ঘুরে বেড়ায় এক বিশেষ জনের খোঁজে, তিনি তাঁর মনের মানুষ সে মানুষ পাওয়া কি সহজ কথা ? অজ্ঞান অন্তঃকরণে যখন চেতনার উন্মেষ ঘটে, তখন চৈতন্তের আলোকে মনের মানুষ ধরা দেন, যিনি তাঁর চির আকাঙ্ক্ষিত মনের মানুষ যাকে পেলে সবই পাওয়া যায়—যাঁকে জানলে অমরত্ব লাভ হয়।
‘আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যেরে ৷’
বাউলের প্রথাগত কোন ধর্ম নেই । সকল ধর্মই তার কাছে সমান । সকল ধর্মেই বাউলের মতি আছে। কারণ বাউল জীবনধর্মকে অস্বীকার করে না। সর্ব ধর্মেই তো মানুষের কথা—মানুষের মঙ্গলের কথা—জীবনের কথা—সুতরাং বিরোধ কোথায় ?
অহংকার, স্বার্থপরতা এবং অজ্ঞান ভাবাবেগবশতঃ মানৰ ধৰ্ম নিয়ে মারামারি-ঝগড়া করে। তাদের অন্তরে যদি একটু ভগবৎপ্রেম জাগ্রত হত, তাহলে তারা এইরূপ ভুল কাজ করত না সকলের মধ্যে শ্রী ভগবানের প্রকাশ দেখত। । সমস্ত বিদ্বেষ ভুলে মানুষকে আরও অধিক ভালবাসত।
সম্প্রদায়গত সংস্কার প্রাচীরের মত, যা মানুষের জীবনকে বেষ্টন করে ফেলে—বদ্ধ করে শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়—মানুষ হয়ে ওঠে অমানুষ ।
বাউল জীবনধর্ম তথা মানবধর্মকে অস্বীকার করেন না। তাঁদের নেই কোন জাতি-বিদ্বেষ নেই কোন ধর্মভেদ। সুতরাং শ্ৰেণীচেতনা, গোষ্ঠীচেতনা, সম্প্রদায়চেতনা – এগুলি বাউলের ভিতর নেই তাদের মধ্যে আছে এক সার্বিক সর্বজনীন প্রেমচেতনা – যা সকলকে আপন করে কাহাকেও করে না পর।
সর্বধর্মের সমন্বয় ঘটাতেই বাউলের মাধুকরী বৃত্তি। প্রচলিত কোন ধর্মীয় সংস্কারের গতীর দ্বারা তারা আবদ্ধ নন ৷ সমস্ত প্রকার সংকীর্ণ সংস্কারের বাইরে অনন্ত উদারতার মধ্যে তাঁদের অবস্থান । বাউলমনের প্রসারতা সেই কারণেই খুরা বিস্তারিত। তাঁদের নিকট মানুষই সমস্ত কিছু—মানুষের সাধনাই সর্বাপেক্ষা বড় সাধনা।
গান হল বাউল সাধনার প্রধান অঙ্গ। ‘বোল’ হল বাউল মতের মর্মকথা । এই গান বা বোলের ভিতর দিয়ে বাউল তার নিজের দর্শন বিশ্বসংসারে পৌঁছে দেয়। আর গানের মধ্যেই লুকিয়ে গানের ভিতর দিয়েই বাউলের থাকে সাধনতত্ত্বের গুপ্ত সংকেত – গানের মর্মকথা সংরক্ষিত হয় পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরপুরুষের জন্য ।।
বাউল অনাসক্ত, তাঁর কাছে কোন প্রশ্ন নেই নেই কোন বিতর্ক নেই জাগতিক স্বস্তি-অস্বস্তি নিয়ে কোন মাথা ব্যথা। তাদের শুধু একটাই জিজ্ঞাসা – ‘আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।’
প্রিয় আত্মন্ ! পাঁকাল মাছের মতো নির্লিপ্ত বাউলের সামাজিক অবস্থান।
বাউলের হাতের একতারাটি শুধু বাদ্যযন্ত্রই নয়, ওটা একাগ্রতার প্রতীক। একতারার একটি তারের মতো বাউলের জীবনে একটি সুরই বাজে – সেই অধর –মনের মানুষকে ধরার সাধনাযা অধরা মাধুরী।
বাউলদের মধ্যে নারীর স্থান খুব উচুতে এবং নারীর ভূমিকা অপরিহার্য । বাউলরা মনে করেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর সকলেই নারী বা প্রকৃতি। বাউলের সাধনাও সেইহেতু নারীরূপে—প্রকৃতিভাবে । বাউলরা নারীর প্রতীক হিসাবে লম্বা চুল চূড়া করে বাঁধে, কাছাহীন কাপড় পরে, হাতে ও গলায় গহনা পরে । আর কাপড়ের গৈরিক রং বাউলের নিরাসক্তির প্রতীক । বাউলের পরিধেয় কৌপীন রজঃস্বলা নারীর প্রতীক । সেইহেতু বাউলদের ভিতর কৌপীনকে বলা হয় রাধা আর ভোরকে বলা হয় দুইজনাই দুইজনের পরিপূরক। কৃষ্ণ ।
বাউলরা সাধনা করেন নারীরূপে কারণ নারীর প্রেমই সার্থক ও শাশ্বত। নারীর প্রেমে আছে একান্ত নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা । পক্ষান্তরে নরের প্রেমে কামভাবের আধিক্য। সেই কারণে সে এক- নিষ্ঠ হতে পারে না। নারীই একমাত্র মধুর প্রেমের আধার। আর এই জন্যই বাউলের নারীরূপে উপাসনা । বাউলদের এই নারীতত্ত্বটি খুবই গভীর এবং একান্ত গুহ্য । বাইরের লোকের কাছে তাঁরা এসব বলেন না—কেবলমাত্র অন্তরঙ্গ জনের কাছে এই বিষয়ে চর্চা করে থাকেন ।
বাউলরা প্রচলিত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে উদাসীন। সাধারণতঃ লোকে এঁদিগকে পাগল বলে থাকে। বাস্তবিক সত্য সত্যই তাঁরা পাগল, কিন্তু প্রেমের পাগল । আর সেই প্রেম হল অখণ্ড – সর্বজনীন ভাগবৎ প্রেম ।
এইজন্য মানুষকে ভালবাসাই বাউলের সাধনা—বাউলের ধর্ম।
প্রশ্ন—আপনার আলোচনা হতে বুঝলাম – বাউলের নিকট প্রেমের স্থান সত্যই খুব উচ্চে, এই প্রেম সম্পর্কে আরও কিছু আপনি বলুন না ?
উত্তর— প্রিয় আত্মন্ ! জগতে নর-নারীর সম্পর্ক ঘিরেই প্রেম । বহুলভাবে প্রচলিত । কিন্তু এই সম্পর্ককে অতিক্রম করেও জগতেঅনেক প্রেমিক এসেছেন, যদিও সংখ্যায় তাঁরা বিরল ৷
যে প্রেম স্বাধীন এবং সর্বজনীন—তাই আদর্শ প্রেম ৷
প্রিয় আত্মন্, নর-নারী পরস্পরকে ঘিরে যে আকর্ষণ বোধ করে—এই আকর্ষণ প্রবৃত্তিজাত। প্রেমের সংজ্ঞায় প্রবৃত্তিকে মানা যায় না । নরনারীর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণটা যে মূলতঃ প্রবৃত্তিজাত এটা যুক্তির দিক দিয়েও অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু প্রাণিজগতের শ্রেষ্ঠজীবন মানবজীবন, তার বিষয়টি নিশ্চয় ভিন্ন। আর মানবও প্রকৃতির হাতের ক্রীড়নক নয় । সুতরাং প্রবৃত্তির তাড়না হতে মুক্ত হওয়া তার সহজাত বৃত্তি এবং সাবলীল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তবুও পরস্পরের প্রতি আকর্ষণের প্রবৃত্তিগত স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করা, যায় না—এটা বড় রহস্যময়! আর ঐ আকর্ষণ থেকেই প্রেমের আবির্ভাব ঘটে এবং আকর্ষণটাও নির্বিকার নয়। কিন্তু তবুও প্রেমকে এত সংকীর্ণ বিচারে আবদ্ধ করা যায় না। এইজন্য মহাজনরা প্রেমকে অনির্বচনীয় বলেছেন।
প্রিয় আত্মন্ !প্রেম অর্থে পরস্পর প্রবৃত্তির নির্বিচার ভোগমাত্র নয়। প্রেম হল একান্ত একনিষ্ঠ এবং অখণ্ড। প্রেম — স্বাভাবিক, সাবলীল, সহজ, নিবিড় এবং অনবদ্য।
জৈবিক কাম হচ্ছে – এক ধরনের আচ্ছন্নতা বা আবেশ, এটা চিরস্থায়ীও নয় । এটা চিত্তের দশামাত্র। নর-নারীর সম্পর্ক ঘিরেই এইআবেশ বা আচ্ছন্নদশা উপস্থিত হয় এবং তা হতে বিকার উপস্থিত হয়।
কিন্তু প্রেম বলতে কেবল নর-নারীর সম্পর্কই নয় এবং শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়। প্রেম স্বাধীন এবং সর্বজনীন। প্রেমই জীবনের প্রকৃতি—যা সহজ, সাবলীল অনবদ্য। সেখানে রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা আর কাম হল আবেশ বা আচ্ছন্নতা। তা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ চিত্তবিক্ষেপ এবং ইন্দ্রিয় বিকার ৷
প্রিয় আত্মন্ ! জীবের প্রকৃতিতে অহংকার হতেই কামের আবেশ হয়। কামের মূলে অহংকার অহংকারমুক্ত চিত্তে কামের আবেশ হয় না। অহংকার নষ্ট হলে ঐ আবেশ বা আচ্ছন্নতার লেশমাত্র থাকে না। তখন চিত্তবিক্ষেপ এবং ইন্দ্রিয় বিকারও থাকে না ৷ থাকে শুধু অনাবিল ভূমানন্দের প্রবাহ প্রেমাপ্লুত চিত্তে শুধু আনন্দ—আনন্দ আর আনন্দ ।
অহংকার প্রধান ব্যক্তিরাই কামুক হন আর অহংকারমুক্ত ব্যক্তিরা প্রেমিক হন।
প্রশ্ন—আপনি এই বিষয়টি আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্ !অহংকার হতেই চিত্তে কামের আবেশ হয় যা মনকে আচ্ছন্ন করলে চিত্তবিক্ষেপ শুরু হয়ে থাকে আর বিক্ষেপ হতেই ইন্দ্রিয় বিকারউপস্থিত হয়। ইন্দ্রিয়বিকার উপস্থিত হলে বিবেক ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে এবং মানব তখন বিবেকরহিত অহসজ কাজ কর্মে লিপ্ত হয় আবার ঐ সাময়িক আচ্ছন্নতা কাটলে মানব অনুতাপ করে ।
সুতরাং এই আচ্ছন্নতা বা ঘোরকে কি করে স্বাভাবিক বলা যায় ? যা মানবকে তার বাস্তব পরিবেশ সম্বন্ধে অচেতন করে এবং ভাল-মন্দ বিবেকরহিত বিকারযুক্ত আচরণ করায় তা কোনমতেই স্বাভাবিক নয় । মূলতঃ জগতের দুর্ঘটনাগুলির এটাই কারণ । এই আচ্ছন্নতাবশতঃ মানব অনেক কিছুই দুর্ঘটনা বা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে জীবনে । এমনকি আত্মহত্যা ও হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। যে নর-নারীর এই আচ্ছন্নতা কেটেছে তারাই বেঁচেছে। আচ্ছন্নতামুক্ত হলেই মানব প্রকৃত বেঁচে যায়—মুক্ত হয়—স্বাধীন হয়। নতুবা সংকট থেকেই যায়, কাজেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থাকে ।
যতদিন নর-নারীর মধ্যে এই ঘোর বা আচ্ছন্নতা থাকে, ততদিন তাদের মধ্যে সম্পর্ক কামজ—যা দাসত্ব— পরাধীনতা। অপূর্ণতা হেতু দীনতাবশতঃ তারা হাহাকার করে। জীবন ভারবহ বা ভারাক্রান্ত বোধ হয় । কারণ কামজ আচ্ছন্নতা হতেই জন্মায় অধিকার বোধ এবং ঈর্ষা। দাবি হতেই উৎপন্ন হয় বিবাদ-কলহ, তখন দ্বন্দ্বময় জীবন বিষময় হয়ে উঠে ।
প্রিয় আত্মন্! মানবের ঐ আবেশ বা আচ্ছন্নতা দূর হলে মানব মুক্ত হয় এবং স্বাধীনতার বোধেবোধ হয়ে থাকে। তখন সে পূর্ব আচরণের কথা চিন্তা করে বা স্মরণ করে হাসতে থাকে।
সুতরাং নর-নারীর সকাম প্রেম বা দেহজ আকর্ষণ একটি আচ্ছন্নদশা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
প্রাণীহিসাবে মানব শ্রেষ্ঠ তথা উত্তম বলে প্রেম তার সহজাত -স্বভাবধর্ম। অনাদিকাল হতে মানবের এই প্রেমই সমস্ত রকমের সংকটময় অবস্থা হতে মানবকে এবং মানব সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মানবের এই সহজাত সহজধর্ম যদি ঐ আবেশ বা আচ্ছন্নতামুক্ত হয়। তাহলেই ওটা হয় মাধুর্যমণ্ডিত চিরসুন্দর প্রেম। আর তা জীবনকে করে তোলে অমৃতময় —মাধুর্যময় এবং ঐখানেই জীবনের সার্থকতা বা পূর্ণতা।
মানবের প্রেম—বিশ্বাস এবং আস্থায় ভরপুর হলে জীবন হবে নিরাপদ। সমাজে নেমে আসবে কল্যাণ বা মঙ্গল যা সকলের চির আকাঙ্ক্ষিত। জীবন হবে সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্। যদি তা না হয়, তা হলে বিচ্ছেদ, বেদনা আর অমঙ্গলরূপ অসহজতাকে চোখের জলে ধৌত করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে মানবকে।
একমাত্র গভীর প্রেমই মানবকে পরস্পর সংযত রাখে—সভ্যতারএটাই লক্ষণ ।কারণ সভ্যতার পরিভাষা সংযম ।
প্রাকৃত নর-নারীর পরস্পর দুর্জয় আকর্ষণ যদি আচ্ছন্নতামুক্ত হয়। তাহলে তাও মঙ্গলের কারণ হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি ঐ আকর্ষণ প্রাকৃত আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন থাকে, তা হলে দুর্ঘটনা ঘটে এবং জীবনে অমঙ্গল নেমে আসে।
প্রেম শুধু নর-নারীর ভালবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—সমস্ত মিলনের সেতুস্বরূপ । সমস্ত বিরোধের অবসান করতে একমাত্র প্রেমই পারে। প্রেমকে আশ্রয় করেই মানবকে বাঁচতে হবে। যতদিন সৃষ্টি থাকবে, ততদিন প্রেম থাকবে –এর স্থায়িত্ব জীবনের প্রলয়কাল পর্যন্ত ।
ভালবাসাই মানবজাতির শেষ উপায় । পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসলেই। মানবকৃত অপরাধ বা অনিষ্ট পৃথিবীতে থাকবে না। চিত্তের যে অবস্থায় মানব আত্মসুখ বিসর্জন দেয়, তাপরের সুখের জন্য যে অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না –তাই প্রকৃত ভালবাসা ।
মানবের ভালবাসা যদি স্বাধীন হয় এবং সেই ভালবাসার যদি কোন পার্থিব কারণ না থাকে, তা হলে সেই ভালবাসা ক্রমে ঘনতর হয়ে বিশুদ্ধ প্রেমভার গ্রহণ করে। ভালবাসা মানবকে দুঃখে সহিষ্ণু। এবং সুখে সংযত করে এবং মঙ্গলময় কার্যে রত করে। সার্বিক মঙ্গলের জন্য ভালবাসাই আত্মত্যাগের প্রেরণা দেয়।
ভালবাসার বেগ সকলেরই অনুভব হয় এবং ভালবাসার অর্থসকলেই বুঝতে পারে—ভালবেসে দেখ।
প্রেম মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারে এবং ভয়কে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে পারে ৷ প্রেমই জীবনের সমগ্র বাধা বিপত্তি এবং ক্ষতিকে তুচ্ছ করতে পারে। আত্মদানে অপরকে সুখী করবার সার্বিক আকাঙ্ক্ষা বা প্রবণতা প্রেমিকের মজ্জাগত, তার শিরায় শিরায় শোণিতাকারে তা প্রবাহিত থাকে ।
প্রকৃত প্রেম মনুষ্যত্বকে ব্যাপ্ত করে । প্রেম প্রতিদান চায় না—সেবা করেই সুখী। যোগ্য-অযোগ্য বিচারও প্রেম করে না। একমাত্র এই প্রেমই মানবের সমস্ত জ্বালা জুড়াতে পারে। প্রেম অবিনশ্বর—প্রেম সুন্দর ।
প্রিয় আত্মন্! উপনিষদে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে রস। যথা -‘রসো বৈ সঃ’। * (* ‘তিনিই রসস্বরূপ ’— তৈত্তিরীয়োপনিষৎ— ২/৭)
যা হতে সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি হয়—তাই রস। এই বিশ্বে যা কিছু সুন্দর তার মূলে এই রস । এই রস, সৌন্দর্য আস্বাদনের মূলীভূত কারণ । আর আত্মারও সৌন্দর্য আস্বাদনের মূলীভূত কারণ ঐ রসই। সেইজন্যই প্রেম অবিনশ্বর—প্রেম সুন্দর ।
প্রিয় আত্মন্ ! মানবের ইচ্ছাশক্তির আবেগকে সুনিয়ন্ত্রিত করে স্থায়ীভাবে রূপান্তর করতে পারলে ঐ প্রেম লাভ হয় । তখন প্রকৃতি- সকল রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং মানব আত্মসংযমী হয়। সেই কারণেই এটা ভাবাবেগ নয়, এটা একান্ত সুনিয়ন্ত্রিত ভাব বা স্থিতি আর এটাই সহজতা
এই সহজস্থিতির উদয় হলে বিশ্বচরাচর মাধুর্যময় আনন্দময় — রসময় হয়ে উঠে প্রেম ভিন্ন আনন্দ নেই আবার আনন্দ ভিন্ন প্রেম নেই ৷
প্রাণঢালা ভালবাসাতেই —আত্মদানেতেই তৃপ্তি প্রেমিক হৃদয় বেসাতি করতে জানে না। প্রেমের মৃত্যু নেই—প্রেম চিরন্তন।
প্রেম না থাকলে এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেত। এত মানুষ যে পাশাপাশি রয়েছে বা থাকছে—এটাই প্রেমশক্তির প্রমাণস্বরূপ ।
প্রিয় আত্মন্ ! প্রতিটি মানবের মধ্যে এই মঙ্গলবোধ নিহিত আর ঐ মঙ্গলবোধের দিকটিই প্রেমে জাগরূক হয়ে উঠে। প্রেমই আত্মিকশক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি যা মানবের ভিতর দেখা যায়।
প্রিয় আত্মন্ ! অমূর্ত ভগবান প্রেমরূপেই জগতে মূর্ত হয়ে উঠেন আর মানবের মাঝেই তাঁর পূর্ণ অভিব্যক্তি।
পরিশিষ্ট _
বাউল
হে পৃথিবী,
আমার মরমিয়া মনে লাগে
তোমার প্রেমের উষ্ণ ছোঁয়া।
তোমার ঐ উন্মুক্ত উদার যৌবন
বারে বারে স্পর্শ করে আমাকে,
তোমার নির্বিকার ঐ নীরবতা অসহ্য
উথলিয়া ওঠে বাউলিয়া মন।
হে পৃথিবী—
পর্বতের চেয়েও ভারী ঐ যৌবন
আর পাহাড়প্রতিম ঐ পুরু নিতম্ব,হ
সেই তনু ঘিরে ভাসে মহাজাগতিক বিস্ময়,
আমার মনে লাগে মরমিয়া হিন্দোল,
আড়ষ্টবক্ষে বেজে ওঠে বাউলিয়া সুর।
হে পৃথিবী—
জীবনের জোয়ার ভাটায় বসে
পান করি সংযত জীবনে
রূপ রস সুধা ৷
ঐ দুগ্ধ ফেনর্নিভ সুউন্নত বক্ষে
তপ্ত স্তনবৃন্ত ঘিরে আছে
আমার আড়ষ্ট রক্তিম বৈরাগ্য।
হে পৃথিবী –
নীল বিস্ময় নিয়ে উঁকি মারে
আমার মরমিয়া মানবিক অস্তিত্ব।
ক্ষুদ্র নরম বক্ষ জুড়ে খেলা করে
আরক্ত লেলিহান আগুন
ত্রস্ত আমার দশ দিগন্ত।
হে পৃথিবী,
আমি বাউল – আমি শরণাগত,
গৈরিক চীর বাকলে ঢাকি নশ্বর শরীর,
জীবনের একতারাতে সাধি
বৈরাগ্যের তারে
মরমিয়া তানে বাউলিয়া গান।
হে পৃথিবী—
আমি বাউল, আমি শরণাগত
অনন্ত যাত্রাপথে ভবঘুরে পথিক।
সীমা-অসীমের খেলা আলখেল্লা ঢেকে
বাউণ্ডুলে হয়ে করি ভুবনভ্রমণ
আর মরমিয়া মনে গায়
বাউলের গান।
ও পৃথিবী -ও জীবন্ত প্রেম,
তোমার ঐশ্বরিক জিভ শুষে নেয়
পার্থিব মানবিক বিকার –
সার্বিক বিকৃতির হল অবসান।
এখন দেহ নেই, দেহাভিমান নেই
কাম নেই–কামনা নেই,
ভাসে শুধু বোধেবোধ
শুধু প্রেম — প্রেম আর প্রেম।
বাউলিনী
চেতনার উন্মেষ সেই ঊষালগ্নে
প্রেমের মর্মমূলে আমি আচ্ছন্ন,
ছন্দ সুষমার অন্তরঙ্গ আকর্ষণে
এ যাত্রাপথ প্রণয়বিহ্বল অভিসার।
আমি মহাকালের নিত্য সহচরী
যৌবনের প্রভাতে বসে
নিয়ত ভালবাসার স্বপ্ন দেখি ।
মনবার্তা বয়ে আনে অন্তঃপুরে
তরুণ সহৃদয় প্রেমদেবতা ।
ওর নিশ্চল দৃষ্টি সৌন্দর্যভরা
ভগবান এঁকেছে ওর নতুন রূপ
অধরা মাধুরী মাখায়ে ।
ঐ প্রজ্ঞালোকে অসীমের ডাক
সাগরের জলে স্বতঃস্ফূর্ত কল্লোল
ঢেউয়ের ছন্দে পূর্ণতার বাঙ্ময় পদধ্বনি
কান পেতে শুনি ঐতিহ্যের স্পন্দন।
আমার রক্তকণায় ওঠে মৃদঙ্গের বোল
নূপুরগুঞ্জিত ব্যঞ্জনায় পুলকিত ধ্বনিলোক
জ্ঞানানন্দে বাজে নটরাজের ভেরি।
ভাবের আবর্তনে জ্বলে মঙ্গল দীপারতি
ঐ থর থর কম্পিত দীপশিখা,
এ পার্থিব দেহ পুলকে রোমাঞ্চিত
কল্পনায় আমি দেবলোকে ।
এখন দেবসভায় ধ্যানলীন প্রসন্নতা
নিত্য লীলামঞ্চে আমি একাত্ম,
আবেগে অবস্তুনির্ভর আকুলতা।
এখানে ভাবাবেগে হারাবার কিছু নেই
আছে শুধু ধ্যানলীন প্রসন্নতা
আর প্রণয়বিহ্বল একাত্মতা।
কেঁদুলী
কোন্ স্বপ্ন ছুঁতে চায় বিবাগী মন
কোন সে ফসল ফলবতী হয় না
কার অপেক্ষায় ?
গৈরিক জলে খেলে প্রেমের ঢেউ
উপরে ভাসে মন,
দেহের তন্তুতে তন্তুতে
বাঁধা আছে সুর একতারাতে ।
প্রেমজুড়ি তরঙ্গ তোলে
সে সুর ছড়ায় জীবনে
আকাশ বাতাস দিগন্তে
গ্রামগঞ্জ হাটে ঘাটে ।
চোরা গন্ধে মাতাল বাউল
মনের মানুষ খুঁজে ফেরে
পথে পথে ঘাটে ঘাটে
ও ভোলা মন,
কোথায় পাবি তারে ?
ভাব ভুবনের মরমিয়া গান
সুরের সম্মোহন ছড়ায়
দিগন্ত হতে দিগন্তে ।
এখন এসো অরূপের হাটে
রূপের ডালিতে —
স্বরূপের পশরা সাজাও
ভাবের ভাবি কর বেচাকেনা
সুরের সম্মোহন ছড়াও
মনের একতারায়—
ও ভোলা মন — মনরে আমার।
এখানে আত্মচেতনার উন্মেষ
সপ্রেম পরিক্রমা
আর ভুবন ভ্রমণ ।
মানবদেহ আর রবে না পতিত
কর্ষণ করো হে ভোলা মন,
জীবনরস মন্থনে উঠে আসে
জীবনে অনির্বচনীয় সুধা—
উর্বর পলিতে সৃষ্ট উর্বরা ফসল,
কাঁচাসোনা রঙ ফসলে
এ মানুষ সোনার মানুষ ।
এ মানুষ মনের মানুষ ।
চড়ুইভাতি
শীতের মিষ্টি স্নিগ্ধ সকাল
আকাশের পর্দা ফুঁড়ে সোনালী রোদ
এক ঝাঁক কিশোর-কিশোরী
ওদের পায়ে হরিণ নাচের ছন্দ,
গঙ্গাগর্ভে হিন্দোলে আন্দোলিত
যুগল তরণী।
স্নিগ্ধ স্বচ্ছ সলিল প্রবাহে ঢেউয়ের দোলা
থেমে থেমে ভাসে অজানা ডাক
এ কোন নিরুদ্দেশে ডুব দেওয়া !
স্মৃতির গুঞ্জন উঠে আসে
অজানা কোন অতীত হতে।
এ মানুষ সোনার মানুষ
এমানুষ ভালবাসার মানুষ
হৃদয়ের অনাবিল জীবনস্রোতে
ভেসে চলে সোনার মানুষ
কোন অচিন অনির্বচনীয় অভিসারে ।
সীমারেখা তটভূমি সবুজ উত্তেজনা
এ হলো জীবনরসের ভোজসভা
নতজানু হই আমি
ঐ মহিমার পদতলে ।
গঙ্গা
প্রিয় গঙ্গা—
তুষারধবল মুকুটমণ্ডিত পর্বতশীর্ষে
কে তোমায় প্রথম কল্পনা করেছিল?
হয়তো বুঝি মহাকাল,
সে বুঝি তোমার পরিকল্পনাকারী বিধাতা ?
নিশ্ছিদ্র পর্বতের বুক ভেঙে
রামধনুর নূপুর পায়ে বেঁধে
সশব্দ তুমুল অবতরণে
কোথায় চলেছ তুমি ?
উচ্চ ভূমি ছেড়ে নিম্নপানে গড়িয়ে
কোথায় নেমে চলেছ তুমি ?
পর্বতের রুক্ষতায় তোমার ভাল লাগেনি বুঝি ?
রুক্ষকঠিন পর্বত তোমায় ভালবাসেনি বুঝি ?
আবেগে আদর করেনি বুঝি ?
জলপ্রপাতের প্রবল আঘাতে
পাথরের দেওয়াল ফাটিয়ে
কেন গড়ে তুলছো গভীর গিরিখাত ?
তীব্র প্রস্রবণের আঘাতে আঘাতে
শিলাখণ্ড কেন ছড়াচ্ছো যত্র তত্র ?
গিরিখাত প্রস্রবণ বন উপবন
তীর্থ তপোবন প্রার্থনা সঙ্গীত স্তুতি
মন্দিরের গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনি
সমস্ত উপেক্ষা করে কোথায় চলেছো—
ও অভিমানিনী গঙ্গা !
কতজন এলো তোমার স্বদেশ হতে
তোমায় ফেরাবার তরে,
কিন্তু হায় !
ব্যর্থ হল সকলে
মিশে গেল তোমার জঠরে
অস্তিত্ব হারালো চিরকালের তরে,
তোমার সর্বনাশা গতি
তাদের আত্মসাৎ করে ছাড়ল ।
কি ভেঙে এত উল্লাস তোমার—
ও গঙ্গা !
পর্বতের গর্বকে খর্ব করেছ বলে বুঝি ?
নিশ্ছিদ্র পাথরের বুকে চিড় ধরিয়ে
ফাটল সৃষ্টি করে বুঝি ?
কার দর্প চূর্ণ করেছ তুমি—
ও গঙ্গা !
প্রতি মুহূর্তে তোমার গর্ভে
জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য কলরোল
বয়ে চলেছ তো চলেছই—
থামবার নামটি মাত্র নেই
তোমার সফেন শিখায়
এতো আগুন কেন ?
কার উদ্দেশে ভেসে চলেছ তুমি,
ও গঙ্গা !
বালিয়াড়ির বুকে এসে এত
নীরব হলে কেন, ও গঙ্গা ?
বালুকাবেলায় এসে এত
প্রশস্ত হলে কেন,
এত শান্ত সমাহিত হলে কেন ?
তুমি নিশ্চুপ নিঃশব্দ নিরুদ্ধ হচ্ছো কেন ?
উন্মুক্ত জলতরঙ্গের সশব্দ ধুলট
আর উড়াচ্ছ না কেন ?
ও গঙ্গা—
গোপন হয়ে যাচ্ছ কেন ?
অভিসারিকার মতো থর থর
কাঁপছ কেন ?
পুলকে শিহরিত হয়ে এত দুলছ কেন ?
কার অস্তিত্বে রোমাঞ্চিত হয়ে
তুমি মেলে ধরেছ নিজেকে ?
কার উদ্দেশে এই যাত্রা
কার প্রতি এগিয়ে যাও তুমি ?
ঢেউ মেলে পাখিদের সাথে
সাগর মেলায় বুঝি
আমি গৈরিক বসনে
নিজেকে ঢেকে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি
কেবল তোমার চলে যাওয়া দেখি
কিন্তু ফিরে আসা বুঝি না।
কামদেব
চিত্তদহরে ফেনিল তরঙ্গে
তুলনা ঝড়ের আলোড়ন,
জ্বেলনা উন্মাদ আগুন ধিকিধিকি
ক’রো না তপস্যার ছন্দপতন।
ও মনশ্চারি মদন !ধ্যান ভঙ্গ ক’রো না।
আমি যোগেশ্বর মহাকাল নই,
ও চিত্তদহনকারী অনঙ্গ, ক’রো না বিক্ষেপ
আমি চিত্তজয়ী তথাগত নই।
ও মুনি-মতিভ্রম কন্দর্প—
পঞ্চশরে বিঁধনা,
আমি যোগীন্দ্র নই ।
কেন কর চিত্ত-বিভ্রান্তি ?
কেন ঘটাও বিক্ষেপ বিকার ?
জর্জরিত ক’রো না এ ত্রি-সংসার ।
আমি বাউল–শরণাগত
মনের একতারায় সাধি
বৈরাগ্যের তারে
মরমিয়া তানে বাউলিয়া গান
শান্ত হও, শান্তি দাও।
ওঁ শান্তি—ওঁ শান্তি — ওঁ শান্তি
ওঁ শান্তি।
প্রকৃতি
(১)
আমাকে বেষ্টন করে আছে প্রকৃতি
আলো-আঁধারের আকীর্ণ পথে,
আমি ক্লান্ত দিশেহারা পথিক
সৃষ্টির খামখেয়ালী ভরা
এ যাত্রাপথ,
প্রকৃতির অমোঘ শাসনদণ্ড
বোঝাপড়া কর—
বশ কর হে পথিক!
সৃষ্টির আদিম অনাদি আহ্বান
সাড়া দিতে বলে
যার সম্ভাবনা অনন্ত ।
প্রকৃতি আহ্বান করে—
সমগ্র রহস্য উন্মোচন করে,
ক্ষিপ্ত ত্রস্তে উন্মুক্ত
মেলে ধরে
প্রকৃতির দেহ মনে লাবণ্য ।
প্রকৃতির দেহ মন লাবণ্য ছড়ায়
প্রকৃতির কোলে জীবন বেড়ে ওঠে।
( ২ )
সেই সুদূর অতীত হতে প্রবহমান—
বিসর্পিল পথে এগিয়ে চলে
গুচ্ছ গুচ্ছ প্রত্যাশা নিয়ে,
প্রজন্ম চলে
ধাপে ধাপে
মানুষ এগিয়ে চলে ।
আদিম প্রস্রবণ আর অন্তহীন স্রোত
সাবলীল ভঙ্গীতে শারীরিক ছন্দ
বাতাসে রক্তের নোনা গন্ধ,
কালের নিয়মে
হারিয়ে যায় জীবনের যোগসূত্র ।
মহাকালের রক্ত চুম্বনের প্রতীক্ষা,
ঔদ্ধত্য নতজানু হয় ।
অস্তিত্বকে স্থিতধী করতে
মানুষের
এখনো অনেক সময় লাগবে।
(৩)
কল্পনায় সে খেয়ালী শিল্পী
স্পর্শে সে মনোরমা উপভোগ।
বিষণ্নতার কুয়াশায় ঢেকে দিও না—
দিও না উচ্ছ্বাস আবেগে তলিয়ে যেতে ।
উদ্দাম যৌবনের অসহ্য আবেদন,
মৌন মাধুরীভরা মদির বাতাস
আর রহস্যময় ঘন বিস্তার ।
ভোরের বন পথের মতো নরম করে তোল ৷
জীবনের স্বপ্ন ভেঙ্গে ভেঙ্গে
হতাশার ধ্বংস-স্তূপ করে তুল না।
বিশুদ্ধ আকাশ প্রকৃতির নিসর্গ
নদীর বুকে হিল্লোল,
বাতাসে বাজে সুর ।
সুপ্তির গহন কাটিয়ে
ভোরের আকাশে আবেগ-রাঙানো ঊষা
নগ্ন সুডৌল রক্তাভ,
গর্বিত পৌরুষের প্রতীক
পৌরুষের দুর্জয় আকাঙ্ক্ষায় প্রকৃতির আরতি
পুরুষের আকাঙ্ক্ষায় স্নান করে প্রকৃতি ।
(৪)
শেষ রাতের বাতাসে শিশিরের কণা
ডানা মেলে উড়ে যায় ফসলের মাঠে।
নীল আকাশের শামিয়ানা তলে
মিঠে-নরম রোদে সুখের আমেজ
ক্ষেত-বাড়ীর ধানের গর্ভে জমা দুধ
নির্মল গন্ধে ভরা মানবিক অনুভূতি।
বুকের মধ্যে কিছু উত্তেজনা,
উদ্বেগে অস্থির দাপাদাপি—
আপাদমস্তক ছোট্ট একটু কাঁপন।
সকালের ফুলে রোদের প্রথম কিরণ
শান্ত দিঘল-নয়না অরণ্য-কন্যা,
চক্ষু-তারায় তিরতির কাঁপন
কিশোরী-মুখে খুশির উদ্ভাস
অরণ্য বিহঙ্গের মিঠে শিস
সম্পৃক্ত বিরহে হৃদয়বিদারি বিদগ্ধ বিলাপ
বৌ কথা কও—বৌ কথা কও।
(৫)
এ দীর্ঘ সুগঠিত অলৌকিক মায়া
প্রতি অঙ্গে ঔদ্ধত্যের নিবিড় প্রকৃতি
তৃষ্ণার্ত চোখে তৃষ্ণার তুষ্টি।
এ দারুণ দহনে দেহ রোমাঞ্চিত
ধ্যানমগ্ন আকাশে স্মৃতির আবেশ
স্মৃতি-মদির বেদনায় উচ্চারিত এই মন্ত্র ।
এ আমার
অনড় সংগোপন বিশ্বাস,
কেবল কুসংস্কার আর অভিমান নয়
ছিন্ন ভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত অভিমান,
যন্ত্রণার মধ্যেও ভরে আছে
আনন্দাচ্ছন্ন অনুভূতি।
ইন্দ্রিয়রা এখন শ্লথ
তারা প্রচ্ছন্ন বিরাগে ক্লিষ্ট,
নৈশব্দের মাঝে ক্রমে স্থিত হয়
বোধাবোধের অনুভূতি।
জীবনের গভীরে অধরা বোধ
সত্তার গভীরে এখন
বোধে বোধ।
( ৬ )
ঐ সুনীল উদার আকাশে অনাবিল আবাসে
কার আভাস, সে কি তুমি ?
ঐ সুনীল সাগরে বিশাল জলরাশি ঘিরে
সফেন ঊর্মির স্পর্ধিত হিন্দোলে
কার আহ্বান, সে কি তুমি ?
ঐ পর্বতের গাম্ভীর্যে নীরব সৌন্দর্যে
কার ইশারা, সে কি তুমি ?
ঐ সবুজ শ্যামলিমা নিবিড় অরণ্যে
শীতল স্নিগ্ধতা জুড়ে
কার স্পর্শ, সে কি তুমি ?
ঐ উপলভরা বেগবতী নদীটি
ওর সর্বনাশা স্রোতের টানে
কার গান, সে কি তুমি ?
এই ছন্নছাড়া উদাস বাউল মরমিয়া একতারাতে
শোনায় কার জীবনগীতি, সে কি তুমি ?
হ্যাঁ তুমি, তুমি—তুমি—তুমি,
শুধু তুমি—একমাত্র তুমি ।
(৭)
এমন পাখিডাকা নির্জন দুপুর
স্বপ্নময় দুর্লভ শান্তির ছায়া
বসে বসে কবিতায় কথোপকথন।
আহা ! সবুজ সুকোমল ত্রিকৌণিক দ্বিপ্রহর,
ভারহীন দিবানিদ্রার অবকাশে
অপার স্বাধীনতায় ছড়িয়ে দিয়েছ
তোমার নিরাভরণ শরীর-সুষমা।
আকাশের বুকে নীলের সাবলীল ছোঁয়া,
রঙে রঙে ছড়িয়ে পড়েছে
জীবনের দিঘল ব্যাপ্তি ।
অসীম স্নিগ্ধতায় অবগাহন করুক
বিরাগবিধুর বাউলিয়া মন ।
তোমার চেতনা ঘিরে—
আমার নিরাভরণ মসৃণ উপলব্ধি।
( ৮ )
রক্তাভ ঔজ্জ্বল্যের দাপাদাপিতে
আগুনের কম্পিত অসমান শিখা
কাঁপছে তোমার নগ্ন শরীর
ও হংসকন্ঠি দিঘল নারী !
আহা, এমন হিমে-ঝরা শীতল রাত্রি
মনের তারল্যে শরীরটা ভিজিয়ে নিয়ে
ভালবাসার উষ্ণতায় প্রাণ সঁপে দিতে হয়,
সঁপে দিতে হয় সমগ্র সত্তা,
আহা এটাই মানুষের জীবন !
দুই উরুর মাঝে জীবন নিয়ে
শরীরকে চারিয়ে দিয়ে
উল্টে-পাল্টে জীবনের অন্বেষণ।
জীবনের ধর্ম হল তাই—
যাতে প্রাণরস পাওয়া যায়,
অহংকে পাশে রেখে
শুধু অনাবিল আনন্দে ডুবে থাকা ।
(৯)
ধরিত্রীর বুকে মাথা রেখে
শুয়ে আছে লতাটি
তির তির নদীটির
কন্ কনে রেখাটি ।
এই উদাসভরা নিদাঘ দিনে
মৌসুমী মেঘেরা ঝরাই নাকো বৃষ্টি ।
গেরুয়ামাখা তেপান্তরে
হাতে লয়ে একতারাটি
কোথায় চলেছিসএঁকে বেঁকে
অভিমানিনী সোনামুখী মেয়েটি,
বাউলমনে শিহরণ তুলে
লুকিয়ে গোপন হাসিটি ।
(১০)
তোর ছন্দে বাজে প্রাণের নূপুর
তোর সুঘ্রাণে জীবনের সুস্বাদ,
তোর সঙ্গ আনে আসঙ্গ-লিপ্সা
আহা পরিচ্ছন্ন কাঁচা কাপড়েরসুখ !
তুই কি সাগরে অশান্ত ঢেউ ?
সুরের রাজহংসী,
হেলে-দুলে ভেসে চলিস্ জোয়ার ভাটায় ।
সাগরের গহনে স্মৃতির অতলে
আমি কি তলিয়ে যাবো,
হৃদয় খুঁড়ে বেদনা কি জাগাবো ?
না—না—না, আমি ভেসে যাবো।
আকাশের বুকে,
লক্ষ্যের আলোর সুতা ধরে
তবে কি ঈশ্বরে পৌঁছাবো ?
জীবনের তালে তালে খুঁজে ফিরবো
মানব রহস্যের আদিবীজ ।
(১১)
কোন তেপান্তরে পাখা মেলেছে
মলয়ানন্দের রোমাঞ্চ,
নিসর্গলব্ধ হলুদ নিমগ্নতায়
পাতাঝরা দিনগুলি হারিয়ে যায়
কোন এক উধাও অসীমে ।
রাতের অবগুণ্ঠন মোচন করে
এই বুঝি ভোর হোল !
ও পাখিরা,
ও মেঘপরীরা, সুরের আকাশে
হারাও কোন নিরুদ্দেশে ?
কখনো কি দেখেছ তুমি
বাদুলে মেঘ কিভাবে নেমে আসে
পর্বত শিখর হতে—
ধীরে ধীরে উপত্যকার বুকে ?
আহা, জলভরা মেঘের মেদুর
নরম ছোঁয়া
জাগায় উপত্যকার আবেগ-অনুভূতি
আর বুক ভরা ভালবাসা ।
(১২)
একটানা বৃষ্টির পর
একটুকরো সোনাঝরা ঝক্ঝকে সকাল ।
রৌদ্র-বিছানো গাছের ডালে ডালে
পাতা-জড়ানো সদ্য-ফোটা মুকুল ।
এই পরিচ্ছন্ন সুন্দর সকালে
তোমার মুখাবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে,
আহা কি বৈচিত্র্য তোমার ছন্দ—
কত সহজ তোমার ভঙ্গিমা !
তোমার উক্তি ঘিরে ঝরে পড়ছে
আমার সীমাহীন স্পর্ধা ।
(১৩)
একটু একটু করে সময় কেটে যায়
অনাহত জীবনের বিসর্পিল পথে।
নদীর অতল গর্ভ হতে উঠে আসে
অভিলষিত স্বপ্নরা ।
আকাঙ্ক্ষারা জন্ম নেয়
জীবনের ভাঁজে ভাঁজে,
অবাক মানুষের দিন-পঞ্জিকা
আশ্চর্য মনের গতি !
ঐ নীল চোখের নিবিড়ে নীরব ছোঁয়া
আমার অস্থি-পঞ্জর ভেদ করে
হৃৎপিণ্ড কাঁপছে,
কাঁপছে বাতাসের মর্মরে নির্ঝর ।
বাদামী ত্বকের উষ্ণতা মাপবে
স্বর্ণকেশী শুভ্র মেয়ে ৷
পৃথিবীর স্পর্শে জাগে কবোষ্ণ-বোধ
সীমার নিরিখে কাঁপে নরচেতনা ৷
ঐ নীল চোখের মগ্নতা ঘিরে
জেগে ওঠে অনাবিল কবিতারা,
আমার চেতনায় তুমি মরমিয়া দোলা
বেদখল জমি চলে যাচ্ছে এখন
যথার্থ প্রাপকের হাতে।
(১৪ )
আকাশেরপ্রান্ত ছুঁয়ে র’য়েছে
প্রকৃতির নীরব সবুজ উত্তেজনা,
কৈশোর-গন্ধী জীবনের গোপন অঙ্গনে
সীমাহীন অখণ্ড অস্থির ।
স্মৃতির সুখটুকু ঘিরে জাগুক অনুভূতি
তোমার ছোঁয়ায় হোক সমস্ত গ্লানির অবসান ।
এক পসলা বৃষ্টি ঝরাক্ ধরিত্রীর বুকে,
ধুয়ে দিক জীবনের সব আবর্জনা ।
আহা, এই নৈসর্গিক অবকাশে—
এসো উৎসবেয় ক্ষণিক আনন্দে
মিলে-মিশে হয়ে যায় একাকার।
(১৫)
ফুলের গন্ধমাখা আকুল উজ্জ্বলতা
প্রকৃতির স্বর্ণরঙিন স্বপ্ন-পরাগ,
আহা, তোমার মুখে ঝরে পড়ছে
সাদা টগরের শিশিরভেজা পাপড়ি।
সুদূর দিগন্তে বিধুর জ্যোৎস্নায়
পৃথিবী ছুঁয়েছে তৃতীয় প্রহর ৷
তারাভরা আকাশের কোলে
অনিমেষ নিরবচ্ছিন্ন ধ্রুবতারা,
পৃথিবীর নিসর্গ ঘিরে চিকণ লাবণ্য
রাত্রি হাসে জীবনের বাতায়নে।
খোলা জানালা বেয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানায় পূর্ণিমা,
তির তির কাঁপছে তোমার সর্বাঙ্গ শরীর ।
(১৬)
এসো দগ্ধ-শ্মশান থেকে উঠে
পৃথিবীর প্রত্যঙ্গ উঠুক কেঁপে।
এসো চুম্বন করি মৃত্যুর মধুর ঠোঁটে
এসো মত্ত হও অমৃত জীবনরসে।
নাও তনু—নাও প্রাণ
প্রাণে প্রাণ বাজুক, হোক এক প্রাণ,
আজ সারারাত ধরে একান্তে
শুধু কবিতা শোনাব তোমাকে।
( ১৭ )
তোর নিবিড় নীল চোখের উত্তাল আঁধারে
চম্কায় চিকণ বিদ্যুৎ বাণ।
আকাশের আলনায় দোলে-দোলুল
একাদশীর বাঁকা চাঁদ।
এই নির্জীব ঊষর পাথুরে ভূমি
নীচে যার স্পর্শে শুয়ে নেয় জীবনের রস।
তোর ওষ্ঠের উষ্ণতা ছুঁয়ে যায়
আমার নিভৃত কোমল চেতনা
রেখে যায় গোপনে গভীর চুম্বন ।
ও নীল আকাশ, ও নীল সমুদ্র
নিবিড় আলিঙ্গনে নিরবধি চমকাও,
চমকাও ঊষর-কর্কশ পাথুরে ভূমি,
চমকাও অনাবাদী পৃথিবীর কুমারী শরীর।
সবুজ উত্তেজনা ভরুক পৃথিবীর যৌবন
হাসুক ধরিত্রীর অনাবিল সুষমা।
ভরুক আমাদের জীবন
উঠুক চমকে আমাদের মন-প্রাণ।
(১৮)
এমন নৈসর্গিক আঁধারের রাত্রি
ভয়-ভীতি উৎকণ্ঠার দৃশ্যপট ।
এ যেন চেতনার সাথে
নিরবধি অস্তিত্বের লড়াই।
মহাপ্রকৃতির মহাযজ্ঞের মহাসন্ধিক্ষণ
কেউ কি কোনদিন
উপেক্ষা করতে পারে ?
মরমিয়া মন ছুটে চলে কোন সুদূরে
অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির ছন্দে
ছুঁতে চায়কোন রহস্য
জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে।
বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা ছেড়ে
দূরে— দূরে— অনেক দূরে,
নিখিল বিশ্বের পরপারে।
কথামালার শব্দতরঙ্গ পেরিয়ে
কবিতা হয়ে ওঠে স্রষ্টার মহিমা।
অজ্ঞেয় চেতনা আপ্লুত করে
অধীর আনন্দে আবিষ্ট বাউলের মন
পুলকে পুলকে জাগে অমৃত উল্লাস ৷
মরমিয়া মনের হিন্দোলে ভাসে
বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদ।
হায় বাউল-মন,
তুই কি কবিতার হাটে বসে বসে
করে যাবি জীবনের মাধুকরী।
(১৯)
জীবন কোন বাধা মানতে চায়না
ছুটে যেতে চায় হাজার বাঁধন ছিঁড়ে
ধরিত্রী-বুকে সবুজ খেয়ালি উন্মাদনা
মুঠো মুঠো আনন্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।
পৃথিবীর অনাদি অন্তরে ।
আহা প্রকৃতির বুকে সবুজের নিমন্ত্রণ
পাথরের শরীরে ভাঁজে ভাঁজে জলের সুঘ্রাণ
বাউল-মন ছুটে যায় কোন সুদূর অতীতে
জলের সারল্যমাখা প্রাগৈতিহাসিক পথে ।
মানুসী আকাঙ্ক্ষা হানা দেয় সত্তার গভীরে
অচিন অধরাকে ধরার নেশা।
মনটা বাউণ্ডুলে হলে কি হবে
জীবন তো ধরা প্রাণের টানে
তবুও জীবনের দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে
সংগোপনে সকলের অজান্তে ৷