[ মধ্যমগ্রামের ক্যাম্প লাইফ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। আজ সেই আলোচনার পরবর্ত্তী অংশ।] ….. মধ্যমগ্রামে থাকাকালীন দু’বার আমার কাছে বিবাহের প্রস্তাব এসেছিল। প্রথম প্রস্তাবটি একটি মেয়ে নিজেই করেছিল। ও আমাকে ‘দাদা’ বলতো, ভাইফোঁটা ও দিয়েছিল। তারপর একদিন হঠাৎ আমাকে সলজ্জ ভঙ্গিতে বললো, ‘রবীনদা আমি তোমাকে ভালোবাসি!’–এইকথা বলে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তৎক্ষণাৎ তার থুতনিটা ধরে মুখটা তুলে ওর চোখের দিকে চেয়ে বললাম, ‘কিন্তু আমি যে তোর বাবা রে !’ সে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘আমি তো তোমাকে দাদা বলি।’ আমি বললাম, “এখন তাই বল্__ তবে দু’দিন পরে তুই আমাকে ‘বাবা’ বলবি।” এখানে অর্থাৎ বনগ্রামে আশ্রম হওয়ার পরে ও আমার কাছে দীক্ষা নিয়েছে। ওকে তখন আমি বলেছিলাম_’ তুই মন দিয়ে লেখাপড়া কর্, তোর অনেক পড়াশুনা হবে। আর তোর ভাল বিয়ে হবে।’__ হয়েছেও তা! আর এক দিন এক ভদ্রলোকের স্ত্রী আমাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ডেকে নিয়ে গেল, খুব যত্ন করে খাওয়ালো। ভদ্রলোক সেরকম কিছু বলছেন না_ কেবল একথা সেকথা ! কিন্তু ওনার স্ত্রী সরাসরি তাঁদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। বললেন, ‘বাবা ! হোলেই বা তুমি খ্রীষ্টান—এমনতো আজকাল কতোই হয়।’ আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম, ‘মাসিমা আমাদের কিন্তু বংশে পাগলামির একটা ধারা আছে। আমার বাবার ছিল, আর আমার তো আরও বেশী। ছোটবেলায় একবার খুবই বেশী হওয়ায় আমাকে সতেরবার ইলেকট্রিক চার্জ দিতে হয়েছিল। তবে এখন অবশ্য অনেকটা সুস্থ কিন্তু কি জানি কখন আবার বাড়াবাড়ি হয় !’ আমার মুখের কথা শেষ না হোতেই ভদ্রলোক তেড়েমেড়ে উঠলেন – ‘এইজন্যই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি! খোঁজ- খবর না নিয়েই প্রস্তাব দিয়ে বসলে – আমি আগেই নিষেধ করেছিলাম’—ইত্যাদি ইত্যাদি । আমি মনে মনে হাসতে হাসতে ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে camp-এ ফিরে এলাম। যাইহোক সাধুদের এরকম নানান রক্ষাকবজের দরকার হয়। প্রয়োজনে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে তা প্রয়োগ করতে হয়_ নানারকম সামাজিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। মধ্যমগ্রামে camp-এ থাকাকালীন আমরা এক বন্ধুর বিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের camp-এর এক বন্ধুর সাথে একটি মেয়ের ভাব- ভালোবাসা হয়। কিছুদিন মেলামেশা করার পর মেয়েটির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও ছেলের বাবা এ বিয়ে কিছুতেই মেনে নিলো না ! ফলে আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে মেয়ের বাবাকে রাজি করিয়ে camp থেকেই মেয়েটির বাড়িতে বাসে করে বর নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলাম। আমিই আয়োজক, আমিই বরকর্তা। আমি ঐ একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করেছিলাম বা বরযাত্রী গিয়েছিলাম। তারপর একজনের একটা বাড়ি ঠিক করে সেখানেই বৌভাত খাওয়ানো বা ফুলশয্যার ব্যবস্থা করা হোলো। আমরা ক্যাম্পের সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। হৈ-হৈ করে বিয়ে হয়ে গেল। পরে ছেলের বাবা-মা ঐ বউকেই মেনে নিয়েছিল, এখন ওরা সুখী দম্পতি। মধ্যমগ্রামে কয়েক মাস ছিলাম তাতেই কতো ঘটনা ! মাঝে আমার এমন একটা ভাব হোলো যে — সবার মুখ দেখেই তার অতীত জীবনের ঘটনা হুড় হুড় করে বলে দিতাম। দ্যাখো, প্রত্যেকের জীবনেই কিছু গোপনীয় দিক থাকে_ সে সব ফাঁস হবার ভয়ে অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। তৃষাণ এই ব্যাপারটাতেই আকৃষ্ট হোলো। ও প্রথমটায় ভাবলো আমি বোধহয় প্লানচেট জানি। একদিন ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘রামকৃষ্ণের দেখা পাব কিনা ?’ ওর মাথায় তখন ঐ একটাই চিন্তা, আমি বললাম, ‘রামকৃষ্ণ যদি শরীরধারণ করেনও তবে তো তাঁর নতুন শরীর হবে। সেই দাঁত-ফাঁক, দাড়িওয়ালা একটা প্রৌঢ় ব্যক্তির যে ছবি তুমি মনে গেঁথে রেখেছো__ সেই শরীরের কাউকে তো পাবে না ! কারণ সে শরীর কাশীপুর শ্মশানে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।’ একথা শুনে তৃষাণ হতাশ হোলো –এরকম করে ও কখনও ভাবেনি। বললো_ ‘তাহলে কি খুঁজে পাবো না ?’ আমি বললাম, ‘ খুঁজে পেলেও বা তাঁকে চিনবে কি করে ?’ তৃষাণ চিন্তায় পড়ে গেল, বললো_’তাইতো!’ আমি বললাম__ ‘তবে ঠিক ঠিক খোঁজ থাকলে তিনিই তোমাকে চিনে নেবেন। তাই বাইরে না খুঁজে নিজের অন্তর্জগতে খোঁজো। সময় হোলে তিনিই তোমার হাত ধরবেন। ….. (ক্রমশঃ)