ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন – ‘কলিতে নারদীয় ভক্তি।’ আমরা গুরুমহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ‘গুরুমহারাজ ! এই নারদীয় ভক্তি ব্যাপারটা কি?’ উনি এককথায় বলেছিলেন – ‘ভক্তিযোগ অবলম্বন।’ ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে নারদীয় সুক্ত রয়েছে — ওখান থেকে ভক্তিযোগের কথা আমরা জানতে পারি ৷ তারপরে শ্রীমদ্ভাগবতের ভক্ত-ভগবানের লীলাকাহিনী এবং গীতার ভক্তিযোগ অধ্যায় ইত্যাদি থেকে এই সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পেরে থাকি আমরা ৷ কিন্তু একটা কথা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে যে, প্রেম-ভক্তি-ভালবাসা-স্নেহ-প্রণয়-মান-অভিমান-অহংকার ইত্যাদিগুলি তো মানুষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা ৷ এগুলি মানবের প্রকৃতিতেই রয়েছে — যা স্বতঃ উৎসারিত ! জীব horizontal(কীট-পতঙ্গ_সরীসৃপ-পাখী-পশু) থেকে বিবর্তনে (evolution) Vertical হবার পর অর্থাৎ হোমো হ্যাভেলিস থেকে হোমো ইরেক্টাস হয়ে হোমো স্যাপিয়েনস পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় এবং আরও উন্নত অবস্থায় সমাজজীবনে মানবের সংবর্তনে অর্থাৎ ইতর মানুষ থেকে দেবমানব, ঋষিমানব বা মহামানব-রূপ যে অন্তর্জগতের বিবর্তনের ফলে_ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে মানুষ ৷
গুরুমহারাজ বলেছেন যে, ‘এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে এক একটা জীবন বা এক একটা জন্ম যেন এক একটা অভিজ্ঞতার সিঁড়ি ৷ যে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে পূর্ণত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে মানব ৷
আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা এই যুগের যুগপুরুষ করুণাময় ভগবান স্বামী পরমানন্দের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেই প্রেমময় পুরুষের পদপ্রান্তে বসে তাঁর শ্রীমুখের অমৃতময় সুধারূপ বানী শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম ! তাইতো সেই মহাপ্রেমিকের প্রেমের কথা, করুণার কথা আপনাদের সকলের সাথে একটু ভাগ করে নেবার প্রচেষ্টাতেই “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা” – রচনা শুরু হয়েছিল !
আমরা মেমারীর (শ্রীধরপুর) আশীষ মাস্টারমশাইয়ের সাথে গুরুমহারাজের ‘গুরু-শিষ্য সংবাদ’-এর কিছু কিছু অংশ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। অবশ্য একথাটাও ঠিক যে, এই ধরণের ‘গুরু-শিষ্য সংবাদ’ পরিবেশন – আমাদের গুরু ভাইবোনেরা প্রায় সকলেই করতে পারেন ৷ কারণ তাঁদের সকলের সাথেই গুরুমহারাজের বহু কথা হয়েছে, স্মৃতির মনিকোঠায় ধরে রাখার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে ৷ কোনো কোনো ভক্ত বেশি যোগ্য বা বেশি সৌভাগ্যবান – যাঁদের সাথে গুরুজীর অধিক লীলা হয়েছে (গুরুজী তাদেরকে অধিক সঙ্গ দিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে যাবার সময় সঙ্গে নিয়েছেন, বহু আলোচনা করেছেন, অনেক জীবনমুখী শিক্ষা দিয়েছেন) অর্থাৎ তাদের সাথে উনি অধিক মজা গ্রহণ করেছেন এবং তাদেরকে অধ্যাত্মপথে আর একটু বেশি এগিয়ে তোলা বা ‘মজানো’-র কাজ করেছেন ৷
সুতরাং আশীষ মাস্টার যেন আমাদেরই একজন(অর্থাৎ অগণিত পরমানন্দ ভক্তদের একজন প্রতিনিধি) ! যাই হোক, এখন আমরা শুনবো ওই মাস্টারমশাইয়ের সামনে ঘটে যাওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য জিজ্ঞাসা উত্তরের (সিটিং) ঘটনা ৷ একদিন মাস্টারমশাই স্কুল থেকে সরাসরি বনগ্রামে গিয়ে গুরুমহারাজের সিটিং-এ গিয়ে গুরুজীকে প্রণাম করে এবং প্রসাদ গ্রহণ করে (গুরুজীকে প্রণাম করলেই উনি সকলকেই কিছু না কিছু প্রসাদ দিতেন) আসন গ্রহণ করেছেন – এমন সময় জিজ্ঞাসা-উত্তর শুরু হয়ে গেল (আসলে শনিবার বা কোনদিন একটু আগে স্কুল ছুটি হোলে উনি বিকালের সিটিং শুরু হবার আগেই পৌঁছে যেতেন ৷) ৷
একটি তরতাজা লেখাপড়া জানা আধুনিক পোশাক পরিহিত যুবক বেশ উদ্ধত কন্ঠে গুরুজীকে জিজ্ঞাসা করে বসলো – ” আপনিও মানুষ__আমিও মানুষ, আপনারও হাত-পা-চোখ-মুখ ইত্যাদি যেমন আছে — তেমনি আমারও তো সবকিছুই রয়েছে ৷ আমি দেখতে পাচ্ছি – আপনার সাথে আমার শুধু পোশাকে পার্থক্য ! আপনি গেরুয়া পাঞ্জাবি-কাপড় পড়েছেন__ আর আমি প্যান্ট-শার্ট পড়েছি ! তাহলে আপনিই বলুন – এছাড়া আপনার সাথে আমার কি অন্য কোনো তফাৎ রয়েছে ?” গুরুমহারাজ ঐ ছেলেটির উদ্ধত-ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা শুনে রাগ করা বা দুঃখপ্রকাশ করা তো করলেনই না বরং মুখে মৃদু হাসি নিয়ে তাকে এককথায় উত্তর দিয়ে দিলেন।
গুরুমহারাজ বললেন – ” শোনো ! তুমি যে কোনো যুবতী নারীকে দেখলে তাকে ‘কামিনী’ মনে করো ! আর আমি জগতের সমস্ত নারীকেই “জননী” বলে জানি — তোমার সাথে আমার এইটুকুই তফাৎ !” ছেলেটি সেই যে মাথা নিচু করেছিল, সমস্ত সিটিংচলাকালীন আর মাথা তোলেনি ৷৷
(বাকি জিজ্ঞাসা-উত্তর পরের দিন)