জিজ্ঞাসু—তারপর(গয়া, বুদ্ধগয়া ইত্যাদি অঞ্চলে তখন গুরুজী ঘুরছিলেন) আপনি কোথায় গেলেন ?

গুরুমহারাজ:—এই সময় প্রায় আমার ৬/৭ দিন কোনো কিছু খাওয়া হয়নি। ফলে স্থুলশরীরে ‘মন’-এর প্রভাব পড়তেই প্রচণ্ড ক্ষুধার অনুভব হোতে লাগলো । কিন্তু কি আর করবো_ অনশনক্লিষ্ট দেহ নিয়ে একটা গাছতলায় চুপ করে বসেছিলাম। এমন সময় কয়েকজন ব্রহ্মচারী সেখানে এসে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো এবং জানতে চাইলো যে, আমি কয়েকদিন ধরে অনাহারে রয়েছি কিনা ? আমি ওদের কথায় সম্মতি জানাতেই তারা প্রায় আমাকে কাঁধে করে ধরে নিয়ে গেল মঠাধ্যক্ষের কাছে। নিরঞ্জনী মঠের শাখার অধ্যক্ষ সাধুটি আধ্যাত্মিক মানুষ ছিলেন। উনি যখন ওনার আরাধ্যের সামনে ভোগ নিবেদন করার পর চোখ বুজে ধ্যান করছিলেন, তখন ওনার ইষ্টদেব ওনাকে জানিয়েছিলেন— ‘ তোমার আশ্রমের বাইরে গাছতলায় একজন অভুক্ত ব্যক্তি বসে রয়েছে, ওর খাওয়া না হোলে আমি খাই কি করে ?” অধ্যক্ষ সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েই কাঁদতে কাঁদতে চারিদিকে শিষ্যদের পাঠিয়েছিলেন অনুসন্ধান করতে। তাদেরই একটা দল আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মঠাধ্যক্ষ আমাকে খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন। কয়েকদিন ছিলাম ওখানে। কিন্তু মুশকিল হোলো, ওনার অনুরোধক্রমে কয়েকদিন থাকা সত্ত্বেও উনি আমাকে ছাড়তেই চাইছিলেন না। ফলে আমি ওখান থেকে লুকিয়ে কোনরকমে পালিয়ে এসেছিলাম।

এই ঘটনার পর আমি বুঝেছিলাম যে, যতদিন কোনো আশ্রমে আধ্যাত্মিক মানুষ বা Realised মানুষ থাকেন, ততদিনই সেই আশ্রমের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সবকিছু ঠিকঠাক চলে। ওরকম কেউ না থাকলে সব গোলমাল হয়ে যায় ! তবে এটাও দেখেছিলাম যে, প্রকৃত সদগুরু হোলে তিনি সূক্ষ্মশরীরেও লক্ষ্য রাখেন এবং তাঁর আশ্রমকে অনাচার থেকে বা কোনো আধ্যাত্মিক মানুষের প্রতি দুর্ব্যবহার থেকে রক্ষাও করেন ।প্রয়োজন হোলে সমস্ত রকম সমস্যার ব্যাপারগুলোও তিনি মিটিয়ে দেন।

ঋষিকেশে শিবানন্দ সরস্বতীর আশ্রমে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমি আর ন’কাকা ওদের আশ্রমে ২/১ দিন ছিলাম। শিবানন্দজী তখন স্থূলশরীর ত্যাগ করেছেন। অন্যান্য আশ্রমবাসী সাধারণ মানুষ যে সব ঘরে থাকে, ওরকমই একটা ঘরে আমাদের থাকতে দিয়েছিল। ঐসব ঘরে নানারকম খারাপ কাজ‌ও হয়ে থাকে, ফলে ঘরগুলি সাধন-ভজনের উপযোগী নয়। বরং দেখলাম ঘরে negative field ক্রিয়াশীল ! কিন্তু তখন যারা ঘর বন্টনের দায়িত্বে ছিল, তারাই বা কি করবে বলো__ তারা তো আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত নয়, তারা অতশত বোঝে না । ফলে তারা তাদের মতো কাজ করেছে।

কিন্তু ঐদিনেই (গভীর রাত্রে) ঐ মঠের প্রাণপুরুষ শিবানন্দ সুক্ষ্ণশরীরে প্রকট হয়ে ওনার শিষ্যদের হয়ে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ওনার সাথে নানান বিষয়ে অনেক কথাও হয়েছিলো।

ঐ আশ্রমকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবীতে যোগের প্রচার এবং প্রসার চলছে। এটার প্রয়োজন রয়েছে, ফলে এখনও চলবে এগুলি অনেকদিন।
জিজ্ঞাসু- -বাবা! তাহলে গয়া থেকে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন ?

গুরুমহারাজ—ওখান থেকে সোজা চলে গিয়েছিলাম বৃন্দাবনে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে বঙ্কুবিহারী বা বাঁকাবিহারী মন্দিরে গেছি, সেদিন ঝাঁকিদর্শন উপলক্ষ্যে প্রচণ্ড ভিড়। আমিও সেই ভিড়ে সামিল হয়ে গেলাম। ওখানে সবাই মাথায় ঝাঁকায় করে পূজা নিয়ে যায় আর মন্দির প্রাঙ্গণে অনেককে একসঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে পর্দা একবার তুলে দিয়ে বিগ্রহ দেখায়। তারপর আবার পর্দা নামিয়ে দেয়। ফলে মন্দির-প্রাঙ্গণে খুবই ভিড় আর হুড়োহুড়ির সৃষ্টি হয়। ঐ ভিড়ের মধ্যে একজন হুড়মুড় করে ঢুকে আমার পা মাড়িয়ে দিল। আমার তখন ছোটো বয়স, ফলে খুবই ব্যথা লাগলো ! রাগের চোটে আমি বলে উঠলাম, “অন্ধ হ্যায় কিয়া ? দেখ্ নহি সকতা !!” চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই ব্যক্তিটি ছিলেন ‘সুরদাস’ – (হিন্দিতে অন্ধকে সুরদাস বলে)। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি তো অন্ধ, কি দেখতে এসেছো ?’ ও বলল, ‘দেখনে কে লিয়ে নেহি আয়া, দিখানে কে লিয়ে আয়া হুঁ।’ ওর সেই কথাগুলো শুনেই আমার শরীরে এক ধরণের জ্বালা শুরু হয়ে গেলো( গুরুজী ও ভাবতে শুরু করলেন–“সত্যিই তো ! এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সব কিছুকে স্থুলভাবে দেখতে গেলে একটা জীবন কেন_বহু জীবন কেটে যাবে! তাছাড়া বিগ্রহরূপী ঈশ্বরকে তো অনেকেই দেখতে আসে_সেটা এমন কিছু নয় কিন্তু ঈশ্বর স্বয়ং যাকে দেখেন তারই তো জীবন সার্থক !! এইসব ভাবতে ভাবতেই ওনার শরীরে অস্বস্তি হোতে শুরু করেছিল।) অসহ্য জ্বালায় অস্থির হয়ে ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, যমুনার তীরে। শীতল জলে নেমেও জ্বালা থামে না, সারাদিন ভিজে বালি চাপা দিয়ে পড়ে থাকতাম।। এরকম অবস্থা দেড় মাস ছিল। তারপর একদিন বৃন্দাবনের প্রেম অনুভূত হল যমুনার তীরে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি ! পরে সুযোগ মতো তোমাদেরকে বলব।

এই ঘটনার পর সমগ্র বৃন্দাবন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একজন বড় বৈষ্ণব আশ্রমের মুল মোহান্তরুপী এক সাধুবাবার সাথে আলাপ হ’ল। অনেক আয় আশ্রমের— আমি দশ টাকা চাইলাম, দিল না। বলল, ‘বাপকা আমানত রাখা হ্যায় কিয়া !” বাইরে আসতেই এক জীর্ণ কুটিরে এক পাগলা সাধুবাবার কাছে গেলাম । খুব আদর করল—খাওয়াল। ওনার প্রেমপূর্ণ আচরণের পাবার পর বুঝতে পারলাম যে, প্রকৃত সাধুই একজন সাধুর আপনজন। ঐ সাধুবাবা মায়ের মতো স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে বেশ কয়েকদিন রাখল। তারপর ওখান থেকেও বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম ।

যাইহোক দেখলাম শান্তি বা আনন্দ যা কিছু আছে—তা যোগী বা ধ্যানীর কাছে, জ্ঞানীর কাছে ও প্রেমীর কাছে। তুমি সংসারে থাকলে ক্লেশ তোমাকে স্পর্শ করবেই। যদি তোমার নিজের ক্লেশ না থাকে অপরের দুঃখ-কষ্টেও তোমার ক্লেশ হবে। কিন্তু একমাত্র তুমি যদি বুদ্ধের কাছে থাকো, প্রেমীর কাছে থাকো – তাহলে তা তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই যে তোমরা এখানে আছো, সংসারে কত ক্লেশ ভোগ করো —কিন্তু আশ্রমে এলেই শান্তি পাও_পাওনা কি বলো !!

অনেকে এখানে এসে শুধু ঘুমায়—বাড়ীতে নানান চিন্তায় হয়তো ভালো করে ঘুমাতে পারে না। অনেকে দেখি সিটিং-এই ঘুমিয়ে গেল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকছে বলে,অন্য লোক বিরক্ত হয়। ওইটা দেখে আমাকে আবার বলতে হয়__ “আহা ঘুমাক না ! ওকে Disturb কোরো না।

যাইহোক, এইভাবে নানান ঘটনার অভিজ্ঞতায় আমি এটাই বোধ করেছি___ ধ্যানে, জ্ঞানে এবং প্রেমেই আনন্দ ৷৷ তাছাড়া প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পাওয়া বড়‌ই কঠিন।।