আমরা আগের দিন দেখেছিলাম যে, একটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক গুরুজীকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, তার সাথে গুরুজীর তফাৎ কি ? এর উত্তরে গুরুজী তাকে উভয়ের জগৎ সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কথা বলেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন যে, ‘সকল নারীকে তিনি জননী হিসাবে দেখেন কিন্তু ওই যুবকটি (বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ) তা পারে না !’
সেদিন সিটিং-এ অনেক লোকের মাঝে একজন গেরুয়াপড়া (যে কোনো অন্য একটি পরম্পরার মানুষ) সন্ন্যাসীও সেখানে বসে গুরুজীর কথা শুনছিলেন ৷ উনি যখনই দেখলেন – গুরুজী ওই যুবকটিকে এককথায় চুপ করিয়েছিলেন, তখন এবার উনি সাথে সাথে বলে উঠলেন – ” কিন্তু মহারাজ ! আমি তো একজন ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসী ! আমি সকল নারীকেই মাতৃজ্ঞান করি। তাহলে আমার সাথে আপনার পার্থক্যটা কি ?” সাধু ব্যক্তিটির কথাটা তখনও শেষ হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে গুরুজী বলে উঠলেন – ” আমি জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি এই তিন অবস্থাতেই দ্রষ্টাস্বরূপ থাকি, সকল অবস্থাতেই আমি জানি যে আমি এইগুলির মধ্যে নাই, আমি চিরস্বাধীন — নিত্য-মুক্ত-অবিনশ্বর আত্মস্বরূপ ৷ কিন্তু আপনার সেই বোধ হয় নি ৷ আপনি ওই তিনটি অবস্থা (জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি)-য় নিজেকে পৃথক রাখতে পারেন না, আপনি ওই তিন অবস্থার অধীনে থাকতে বাধ্য হ’ন ৷ — এটাই আপনার সাথে আমার পার্থক্য !”
এইবার মাথা নিচু করে থাকার পালা ওই সন্ন্যাসীটির ৷ সেই ভদ্রলোক খুব বড় মুখ করে সবার সামনে নিজেকে একটু ‘মহান’ হিসাবে তুলে ধরার সুযোগ গ্রহণ করতে চেয়েছিল – কিন্তু শুধু সাজলে তো আর হয় না — সাজলেই ‘সাজা’ হয়, ‘সাজা’ পেতে হয় ! ন’কাকা (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী) এইজন্যেই বারবার বলতেন – ” মন না রাঙায়ে বসন রাঙালি, কি ভুল করিলি যোগী !”
কিন্তু আশীষ মাস্টারমশাইয়ের সেদিন আরো কিছু জিজ্ঞাসা-উত্তর শোনা বাকি ছিল ৷ ফলে আমরা আগে সেইসবগুলো শুনে নিই, তারপর নাহয় অন্যান্য আলোচনা করা যাবে ৷ ঐদিন যেন সিটিংয়ে উপস্থিতজনেদের মধ্যে অনেকেই গুরুজীকে আক্রমণ করার mood-এ ছিল ৷ সেজন্য প্রথমোক্ত যুবকটি এবং সাধুবাবাটি যখন চুপ করে যেতে বাধ্য হোলো – ঠিক তখনই আরেকজন young chap গুরুজীকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলো – ” আমরা এখানে বহুমানুষ বসে আছি, তার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি আপনিই একমাত্র উঁচুতে বসে রয়েছেন এবং একটু গদিযুক্ত দামী আসনে বসে রয়েছেন ! যেখানে আমরা সকলে নিচে পাতা ত্রিপলে বসে রয়েছি ! এইটার কি ব্যাখ্যা দেবেন আপনি ?”
জিজ্ঞাসাকারীর জিজ্ঞাসা শেষ হোতে না হোতেই(আসলে গুরু মহারাজ এইরকমই prompt answer দিতেন। এতোটুকুও ভেবে কথা বলার ওনার প্রয়োজন হোতো না!) গুরুজীর তাৎক্ষণিক উত্তর – ” শিক্ষকমশাই ক্লাসরুমে কোথায় বসেন ? তিনি নিশ্চয়ই ছাত্রদের সাথে বসেন না, তিনি আলাদা করে ছাত্রদের থেকে একটু উঁচু আসনেই বসেন – তাই নয় কি ? এখানে তোমরা যারা এসেছো তারা সকলেই কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহনের উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছো — তাই সেই মর্যাদা দিয়ে তোমরা নিচে পাতা ত্রিপলে বসেছো ৷ যদি কোনোদিন তুমি শিক্ষক হয়ে উঠতে পারো – সেদিন তুমিও উঁচু আসনে বসতে সুযোগ পাবে। তোমার কাছে যারা শিক্ষাগ্রহণ করতে আসবে – তারাই তোমার জন্য উঁচুতে আসন পেতে দেবে ৷ তোমাকে তার জন্য লালায়িত হোতে হবে না ৷ শুধু সাধনার দ্বারা নিজেকে তৈরি করো – শিক্ষক হয়ে ওঠো !
তাছাড়া তুমি আর একটা জিনিসের উপর আঙ্গুল তুললে – সেটা হোলো আমি নরম এবং দামী আসনে বসে সিটিং করছি কেন — তাই তো ? এটার জন্য আমার কোনো ভূমিকা নাই ! আমাকে যারা ভালবাসে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে – তারা এগুলো নিজেরা যত্ন করে তৈরি করে নিয়ে আসে ৷ তারপর আমাকে অনুরোধ করে – ‘এটা কষ্ট করে আপনার জন্য বানিয়েছি – আপনি যদি এটাতে বসেন তাহলে আমার খুব ভালো লাগবে গুরুদেব ৷’ দ্যাখো – আমি তাদের ভক্তি-ভালবাসার মর্যাদাটুকু দিই – এইমাত্র ! না হোলে আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ইতো পথে-প্রান্তরে, পাহাড়ে-জঙ্গলে, ফুটপাথে, রেলওয়ের প্লাটফর্মেই কেটেছে বাবা ! খোলা আকাশের নিচে বসে-শুয়েই আমার রাতের পর রাত কেটেছে ৷ আমার কাছে এই দুই অবস্থাই সমান ৷”