জিজ্ঞাসু — ধ্যানের পথ, জ্ঞানের পথ এবং প্রেমের পথ—এই তিনটির মধ্যে আমার প্রকৃতি অনুযায়ী কোনটি উপযুক্ত তা কি করে বুঝব ?

গুরুমহারাজ— ঠিকই বুঝতে পারবে—এতোকিছু বুঝতে পারছো, আর ঐটা বুঝতে পারবে না ? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন—বাড়ির নতুন বধূটির সঙ্গে শ্বশুর, দেওর, ভাশুর সবার সম্বন্ধ কিন্তু স্বামীর সাথে সবার সাক্ষাতে একরকম ভাব, আবার গোপনে অন্য ভাব ! যে ভাবটা ঐ বাড়ির অন্য কারুর সাথে মেলে না অথবা বলা যায় অন্য কারুর সাথে সেই রকম ভাব হয় না। ঠাকুরের গল্পের তাৎপর্যটা হোলো __এখানে বধূ যেন সাধক আর স্বামী হোলো ইষ্ট। ইষ্টের সাথে সাধক যে ভাব আরোপ কোরে সাধনপথে দ্রুত উন্নতি করতে পারে _ সেইটাই ঐ সাধকের প্রকৃতি। আপন বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই অধ্যাত্মপথে এগিয়ে চলতে হয়। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এইটাকেই বলেছেন—’স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’।

জিজ্ঞাসু—‘অধ্যাত্মবিজ্ঞান’ বলতে ঠিক কি বোঝায় ?

গুরুমহারাজ—যেমন জড়কে জানতে জড়বিজ্ঞান, জীবকে জানতে জীবনবিজ্ঞান, মনকে জানতে মনোবিজ্ঞান, তেমনি অধ্যাত্ম বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে গেলে জানতে হয় অধ্যাত্মবিজ্ঞান। এতোক্ষণ তো অধ্যাত্মবিজ্ঞান নিয়েই কথা হোচ্ছে। বলছিলাম না – স্ব স্ব প্রকৃতিকে অবলম্বন করে অর্থাৎ আপন আপন বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই চেতনার উত্তরণ ঘটাতে হয় । এখানে কেউ কাউকে অনুকরণ করতে পারে না, আর তা করলেও কোনো লাভ হয় না বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উল্টো ফল হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হোলেন বর্তমান যুগের অধ্যাত্মবিজ্ঞানী। সাধারণ মানুষ হয়তো তাঁর এইসব কথা জানে না কিন্তু হিমালয়ের বড় বড় যোগী-সাধকেরা জানেন ! কারণ ঠাকুর সেখানকার(হিমালয়ের) হাজার বছরের সঞ্চিত ভাবরাশিকে আশ্রয় করেই শরীর নিয়েছিলেন। তারপর সেই ভাবরাশিকে synthesis করে আবার তা সংসারে ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন বৃষ্টিধারার মতো।

সাধারণ মানুষ তার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে কখনই হিমালয়ের সঞ্চিত ঐ উচ্চ অধ্যাত্মক্ষেত্র বা positive field- এর সন্ধান পেতো না কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ করুণাবশতঃ এটা করে গেলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কোনো নতুন ধর্মমত সৃষ্টি করে যাননি। কবীর, নানক এঁরাও আধ্যাত্মিক মানুষ ছিলেন, mystic ছিলেন কিন্তু এঁরাও সম্প্রদায় সৃষ্টি করলেন__ আর ঠাকুর সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করলেন। যাঁরা এইটা করতে পারেন তাঁরাই প্রকৃত অধ্যাত্মবিজ্ঞানী।

জিজ্ঞাসু—ধ্যানী, জ্ঞানী এবং ভক্তের আচরণের লক্ষণ কি ?

গুরুমহারাজ:—ধ্যানী বা যোগীর সম্পদ হোলো তার একাগ্রতা ও নিষ্ঠা । সাধনায় অবিচল নিষ্ঠাই ধ্যানীর লক্ষণ। জ্ঞানী হবেন অনাসক্ত আর সদাসর্বদা নিত্যানিত্য বিচারপরায়ণ। বিচারের ধারে জাগতিক অনিত্য বিষয়সমূহের প্রতি মোহ বা আসক্তি কচাকচ্ কেটে যায়। এবার এই দুটো যার মধ্যে নেই, তার চোখের জল ভরসা করে ভগবৎ নাম-স্মরণাদি ও ভগবৎ পদে শরণাগত হয়ে থাকতে হবে। এটাকেই সাধারণত ‘ভক্তি’ বলা হয়। কিন্তু পরাভক্তি আলাদা, জাগতিক দৃষ্টি নিয়ে পরাভক্তির ধারণা হওয়া মুশকিল।