জিজ্ঞাসু –আচ্ছা মহারাজ ! ‘Akbar the Great’– বলা হোচ্ছে, আকবর কি সত্যিই মহান সম্রাট ছিলেন ?

গুরুমহারাজ—এই কথাটা অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে । কিন্তু আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, তোমার সাধারণ বুদ্ধি কি বলে ? আকবর বা যে কোনো মোঘল সম্রাট তো originally মোঙ্গল। যারা ২/৪ পুরুষ আগেই ছিল মরুদস্যু। এদের ছিল ভ্রাম্যমাণ জীবন ! আর মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে আচমকা লুঠতরাজ চালিয়ে, মানুষকে হত্যা ক’রে ধনরত্ন ও মেয়েদের চুরি করে আবার মরুপ্রান্তরে ফিরে যাওয়া —এই ছিল এদের কাজ। তাহলে এদের প্রাচীন কোনো সংস্কৃতি কোথায় ? অনেকে শাহজাহানকে সৌন্দর্যপ্রিয়, শিল্প-সচেতন, সংস্কৃতিবান, রুচিশীল ইত্যাদি বলে থাকে। কিন্তু মোঙ্গলদের original যে সংস্কৃতি, সেখানে তো ঐসব কিছুই ছিল না_ওরা শুধুমাত্র অন্যায় ভাবে গায়ের জোর খাটিয়ে এবং চরম নৃশংসতার মাধ্যমে দিল্লীর তখৎ-এ-তাউসে বসেছিল ! ফলে পরবর্তীতে ওদের(মুঘল রাজাদের) মধ্যে যার যেটাতে রুচি সেটা ভারতে আসার পরেই শিক্ষা করেছিল । আবার অনেক সময় বাধ্য হয়ে ওরা এখানকার রীতিনীতি মেনে নিয়েছিল।

দ্যাখো, অপেক্ষাকৃত প্রাচীন সংস্কৃতি বলতে ঐ অঞ্চলে ইরান এবং ইরাক (পারস্য ও মেসোপটেমিয়া) এই দুটো দেশে ছিল। সেখান থেকে কিছু শিল্পী বা রুচিবান মানুষ মুঘল আমলে রাজদরবারে ঠাঁই পেয়েছিল, আর বাকী যারা মুঘল আমলে ভালো কিছু করেছে_ তারা কিন্তু ছিল ভারতীয়। তৎকালীন শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য সবকিছুই তাদের প্রভাবে এবং তাদের দ্বারাই গড়ে উঠেছিল।

আকবরের কথা বলছো তো—আকবরের শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল টোডরমল নামে একজন হিন্দু অমাত্য। অসাধারণ বুদ্ধি ছিল লোকটির। ওই ব্যক্তিই সম্রাটের মাথায় আর্যচিন্তা ঢুকিয়েছিল ! অন্যথায় আকবর কখনোই এত বিশাল রাজ্যবিস্তার করতে পারতোনা এবং দখলেও রাখতে পারতো না। বাবর যখন দিল্লীর মসনদ দখল করে, তখন তো দিল্লী আজকের মতো ভারতের রাজধানী ছিল না। তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শতখণ্ডে বিভক্ত ছিল ভারতবর্ষ। শত শত রাজ্য আর শত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নরপতি ! বাবরের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল ইব্রাহিম লোদীর এবং পরে শেরশাহের। মহম্মদ ঘোরীর হাতে পৃথ্বীরাজ চৌহানের অপ্রত্যাশিত পরাজয় ও তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত দুর্বল হয়ে যায়। ফলে ঐ অঞ্চল দিয়ে তুর্কী, পারসিক, মোগল এরা বার বার ভারতে ঢুকে পড়তে থাকে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করার চেষ্টা করে(কারণ মোঙ্গলদের আদি বাসস্থান তো মরুভূমি অঞ্চলে_সেখানে জীবনযাত্রা বড়োই tough ! তাই সেইসময় ওদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যেই এখানে স্থায়ী হবার লড়াই চলছিল। ওদের নিজেদের লড়াই-এ ভারতীয় রাজবংশের লোকেরা অর্থাৎ রাজপুত, মারাঠা ও শিখ ইত্যাদিরা প্রথমটায় মাথা ঘামায়নি।

নাহলে দ্যাখোনা__ বাবর ক্ষমতায় এলো কিন্তু এক জেনারেশন এর মধ্যেই তার পুত্র হুমায়ুন রাজ্যচ্যুত হোলো ! হুমায়ুনকে হারিয়ে শেরশাহ ক্ষমতায় এলো কিন্তু সে মারা যাবার পর তার তেমন কেউ শক্তিশালী উত্তরাধিকারী থাকলো না, ফলে মুঘলরা আবার ক্ষমতায় এলো। দিল্লীর দখল নিয়ে এইরকমটাই চলছিল। কিন্তু আকবরের রাজ্যাভিষেক হবার পর টোডরমলের সঙ্গে আকবরের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বুদ্ধিমান টোডরমল আকবরকে বোঝালো_ ‘বিশাল দেশ এই ভারতবর্ষ ! এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য রাজ্য_ অসংখ্য রাজা, কারোর সাথে কারো ভাব নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা সবাই এক যে, তুমি বিদেশী এবং বিধর্মী। ভারতবর্ষের প্রাণ হোচ্ছে “ধর্ম”। যদি তুমি কখনও সেখানে আঘাত দাও তাহলে তোমার পূর্বসূরিদের মতো তোমাকেও মসনদ থেকে বিদায় নিতে হবে। রাজ্যবিস্তার করতে বা গোটা ভারতবর্ষের একছত্র সম্রাট হোতে কখনই তুমি পারবে না।”

তখন আকবর জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তাহলে আমাকে কি করতে হবে ?’ টোডরমল বলেছিল, ‘হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করো । রাজপুতদের মর্যাদা দাও, কারণ ওরা বীর সৈনিক এবং বিশ্বাসী।’ আকবর তাই করেছিল, যোধাবাঈ-এর জন্য রাজপ্রাসাদের মধ্যে শিবমন্দির তৈরি করে দিয়েছিল। আকবর প্রত্যহ খালি পায়ে পূজার পর সেখানে যেতো এবং অমাত্যবর্গ অর্থাৎ জয়সিংহ, যশোবন্ত সিং ইত্যাদির সঙ্গে ভক্তিভরে পূজার প্রসাদ মাথায় ঠেকিয়ে খেতো। ফলে সেই সময় সবাই ভেবে নিয়েছিল__ ‘আকবর আর যাইহোক, অন্যদের মতো নয়। কারও ধর্মবিশ্বাসে তো আঘাত হানে না অতএব একে মেনে নেওয়া যায়।’ আর এটাই হয়েছিল। হিন্দু মানসিকতাই হোলো—যে বা যারা তাদের কৃষ্টিকে মানে, তাকে বা তাদেরকে আর খারাপ ভাবে নেয় না। তৎকালে আকবরের সভাসদদের মধ্যে ৭০% রাজা ছিল হিন্দু, তারা বিরোধ করলে আকবরের সাম্রাজ্য খান্ খান্ হয়ে যেতো ! কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক আর ধর্মের প্রতি সহানুভূতির জন্যই কেউ বিরোধ করেনি।

এই পুরো paln-টা ছিল টোডরমলের। প্রথমটায় হিন্দু রাজাদের আকবরের প্রতি ঘৃণা ছিল কিন্তু শিবমন্দিরে ভক্তিভরে প্রসাদ খেতে দেখে তা ধীরে ধীরে দূর হয়ে যায়। তবে রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও এবং রাজপুতরা আকবরের প্রতি প্রসন্ন থাকলেও_ অন্যান্য জনজাতির কিন্তু সম্রাটের উপর ক্ষোভ ছিল। আকবর দীন-ই-ইলাহি নামে একটা নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছিল। আকবর মুসলমান ধর্মের গোঁড়ামি থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছিল এবং ভেবেছিল অন্য জনজাতির মানুষেরাও এইটা ধীরে ধীরে মেনে নেবে। কিন্তু শিখ বা মারাঠারা ওটা মেনে নেয়নি—বরাবর বিরোধ করেছে। ঔরঙ্গজেবের সময় যখন পুনরায় মুসলমান ধর্মের গোঁড়ামি প্রবলভাবে হিন্দুসমাজের উপরে আছড়ে পড়েছিল তখন‌ই সাথে সাথে সরাসরি বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

মারাঠা জাতির গৌরব হোলো শিবাজী। শিবাজীর প্রতি দৈব অনুগ্রহ ছিল। সদ্গুরু রামদাস সমর্থের শিষ্য শিবাজী আধ্যাত্মিক লোক ছিল। রামদাস সমস্ত রকম শিক্ষা– বিশেষতঃ মার্শাল আর্টের শিক্ষা ওকে দিয়েছিলেন। শিবাজী ৩০-৩৫ ফুট লাফাতে পারতো, ওর তলোয়ার ছিল ৭ ফুট লম্বা। মহাভারতের সময় ভীম যেমন একাই একটা সৈন্যদলকে শেষ করতে পারতো, শিবাজীও যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষিপ্র ছিল, বিপক্ষের বহু সৈন্যকে একাই ঘায়েল করে দিতো। শিবাজীর উপর গুরুর নির্দেশ ছিল–যে কোনো উপায়ে ঔরঙ্গজেবকে মারার ! এইজন্যেই শিবাজী ধরা দিয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের এমনিই security system ছিল যে খালি হাত ছাড়া ঔরঙ্গজেবের কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না । কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কাছে এই খবর যেভাবেই হোক পৌঁছে গিয়েছিল_ তাই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শিবাজীকে নিয়ে আসা হয়েছিল সম্রাটের সামনে। ঐ অবস্থাতেও শিবাজী ছেলেকে নিয়ে জেলখানা থেকে পালিয়ে এলো, এটা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতোই ব্যাপার ! শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে লড়াই এর আগে শিবাজীর দর্শন হয়েছিল যে, ‘শায়েস্তা খাঁকে আগে না মারলে সেই শিবাজীকে মেরে ফেলবে’! ফলে দেখা হবার পর শিবাজীই আগে attack করেছিল।

যাইহোক great বা ‘মহান’ যদি বলতে হয়__তাহলে তৎকালীন রাজাদের মধ্যে শিবাজীকেই বলা উচিত ।
জিজ্ঞাসু—ভারতবর্ষে তাহলে লুটপাট, শোষণ, নির্যাতন ইত্যাদি ইসলাম- ধর্মাবলম্বী রাজারাই করেছে ?

গুরুমহারাজ—এটা আবার কি বলছো ? শোষণ সবাই করেছে, তবে হয়তো ভঙ্গিমাটা সকলের একই রকম নয়। খ্রীষ্টানরা করেনি—ব্যবসার নামে অর্থনৈতিক শোষণ ? সমস্ত দেশীয় ব্যবসাদারদের সব ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং দেশীয় শিল্পসমূহের সর্বনাশ করে দিয়েছিল । ভারতীয়দেরকে ওদের দেশে তৈরি সামগ্রীই কিনতে হোতো—এই তো ইতিহাস । যখন কাপড়-চোপর‌ও ইংল্যান্ড থেকে আসতে শুরু করলো_তখন‌ই চরকা বিপ্লব হয়ে গেল সারা দেশে ! সারাদেশে গান্ধীজীর জনপ্রিয়তার এটাই একটা অন্যতম কারণ জানবে । ইসলাম শোষণ করেছে ধর্মের নামে, কিন্তু হিন্দুরা নিজে তার স্বজাতির প্রতি সামাজিকভাবে কম শোষণ করেছে ? হিন্দুদের সংকীর্ণতা, জাতপাত আর অস্পৃশ্যতা দেশের বেশীর ভাগ জনগণকে দীর্ঘদিন ধরে উপর দিকে উঠতে সুযোগ দেয়নি—এটা নিদারুণ শোষণ ! ঈশ্বরের রাজত্বে এ শোষণ অবাঞ্ছনীয়, তাইতো ভারতবর্ষের উপর নেমে এসেছে বারবার বিদেশীদের আঘাত ।