তাছাড়াও গুরুমহারাজ আরো বলতেন – “যে কোনো পৌরাণিক গল্প-কথা-কাহিনীর যেমন স্থূল রূপ ছিল, তেমনি সেগুলির তাত্ত্বিক রূপ বা তত্ত্বগত ব্যাখ্যাও রয়েছে ৷ গুরুমহারাজ বিভিন্ন পুরাণের নানান কাহিনী ধরে ধরে সেগুলির তত্ত্বগত ব্যাখ্যা করে আমাদেরকে বোঝাতেন ৷ সে যে কি অপূর্ব লাগতো – তা মুখে বলে ব্যক্ত করা যাবে না ৷ আমাদের ‘পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা’র অন্যতম প্রধান রূপকার ধাত্রীগ্রামের আনন্দ আমাকে প্রায়ই বলে – ” শ্রীধরবাবু ! আপনি গুরুমহারাজের বলা পৌরাণিক ঘটনার ব্যাখ্যাসমূহ যতটা শুনেছেন – সেগুলি সব এক জায়গায় করে ফেলুন !” আমি ওর কথায় উৎসাহিত হয়ে কিছুটা শুরুও করেছিলাম – কিন্তু সবটা করা হয়নি ৷ করা হয়নি, কারণ – আমার যে লেখা, সেগুলি স্থান-কাল-পাত্র ভিত্তিক ! একটা সিটিং-এই গুরু মহারাজ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন (যেহেতু বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন level-এর জিজ্ঞাসা রাখতো), সুতরাং সেই স্থানে, সেই সময়ে, সেই সিটিং-এ উপস্থিত ব্যক্তিগণের সামনে গুরুমহারাজ যা যা আলোচনা করেছিলেন – সেইগুলি সংকলন করা হয় “কথাপ্রসঙ্গে”-তে !
তাই যখন যেমন সুযোগ আসে – গুরুমহারাজের পৌরাণিক ঘটনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সেইরকম ভাবেই পরিবেশিত হয় ৷ এই ভাবেই টুকরো টুকরো করে পরিবেশিত হোক – পরে না হয় সেগুলিকে সব একত্র করে কোনো সংকলন করা হবে। এটা করাটাও খুবই জরুরী, কারণ গুরুমহারাজ তৎকালীন (১৯৯১ – ১৯৯৯) চরৈবেতি পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো article, যেখানে কোনো পৌরাণিক ঘটনার হুবহু বিবরণ করা হয়েছে – সেইটি দেখে আমাদের কাছে বলতেন – ” দ্যাখ্ দেখি অমুক বাবু আমার সিটিং-এ বসে কতো কথা শুনেছে, তবু সেই পুরোনোকে নিয়েই পড়ে রয়েছে ! পৌরাণিক ঘটনার আধুনিক ব্যাখ্যা বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও ওরা তো আমার কাছ থেকে শোনে – সেইগুলি লেখার সময় উল্লেখ করতে পারে – কিন্তু ওরা তা করে না ৷ আসলে মানুষ পুরাতনকে নিয়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসে, নতুন কে সহজে গ্রহণ করতে চায় না ৷”
পৃথিবীতে যত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন – তাঁরা মানুষকে ওই ‘পিছনে আটকে থাকার প্রবণতা’ থেকে টেনে টেনে সামনের দিকে ঠেলে দেন ৷ কিন্তু মানুষের স্বভাবই হোলো পুনরায় পিছিয়ে যাওয়া, পুনরায় অতীতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করা ! যাইহোক, আমরা পুনরায় ফিরে যাবো আমাদের মূল আলোচনায় অর্থাৎ ‘দেবাদিদেব মহাদেব শিব’ সম্বন্ধে গুরুমহারাজ কি কি কথা বলেছেন – সেই প্রসঙ্গে !
“ধ্যানস্থ শিবের মস্তকের জটা থেকে গঙ্গার ধারা উছলে পড়ছে” – এই ধরনের যে মূর্তি বা চিত্র দেখতে পাওয়া যায় – সেই প্রসঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিলো ! গুরুমহারাজ শিবের মূর্তির মধ্যে যে পৌরুষ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে – সে কথাও বলেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন – ” যোগীশ্রেষ্ঠ মহাদেব শিব যেভাবে তৎকালীন সময়ে হিমালয়ের সুদীর্ঘ দুর্গমপথ অচ্যুত শৃঙ্গরাজি অতিক্রম করে করে মানুষের কাছে কাছে পৌঁছে মানবসভ্যতা বিকাশের বিভিন্ন ধারার উন্নতিকরণ, নবীকরণ এবং নতুন মত প্রতিষ্ঠার জন্য বহুবিধ সংগ্রাম করেছিলেন – সেইসব রূপকাকারে প্রকাশ করতে গিয়েই শিবের মূর্তির মধ্যে একটা প্রবল পৌরুষের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে।
যোগের চরম শিখরে ‘বিরাজমান শিব’ – এইটা বোঝাতেই গিরিশৃঙ্গের চূড়ায় ‘ধ্যানস্থ শিব’-কে চিত্রায়িত করা হয়। আর উছলে পড়া জলের ধারা হোলো প্রেমের প্রবাহের প্রতীক ৷
যোগের চরম পর্যায়ে সাধক জ্ঞানের ভূমিতে প্রবেশ করে ৷ এখানে জ্ঞানের ভূমি বলতে – আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের কথা বলা হোচ্ছে ৷ আর চরম জ্ঞানীর মধ্যে থেকেই পরম প্রেমের প্রকাশ ঘটে ৷ প্রকৃত “প্রেম” ধরার জন্য উপযুক্ত আধারের প্রয়োজন_ এইজন্যেই স্বর্গ থেকে গঙ্গার ধারার প্রবল বেগ যখন নেমে এসেছিল তখন শক্তিশালী সব কিছুকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। একমাত্র মহাদেব শিব-ই সেই প্রবল বেগ ধারণ করতে পেরেছিলেন। এইজন্যেই গুরু মহারাজ বললেন_’জ্ঞানীই পারেন প্রেমকে ধারণ করতে’।। উনি উদাহরণ হিসাবে আরও বলেছিলেন _’সিংহের দুধ সংরক্ষণ করার জন্য সোনার পাত্র লাগে _ অন্য পাত্রে রাখলে কেটে নষ্ট হয়ে যায়।’
অন্যান্য মানুষের ক্ষেত্রে যেটা আমরা ‘প্রেম’ মনে করে থাকি – তা মানবের করুণা, দয়া, স্নেহ, মমতা, মোহ ইত্যাদি soft গুণসমূহের বহিঃপ্রকাশ মাত্র ৷ আর অল্পবয়সে নর-নারীর মধ্যে যে একটা প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়, সেটি প্রাকৃতিক কারণে ৷ ওগুলি হোলো জৈবিক আকর্ষণ ! স্থান-কাল-পাত্র বদলে গেলেই ওই আকর্ষণ টেকে না। প্রথম যৌবনে ‘যাকে ছাড়া বাঁচবে না’– বলে মনে হচ্ছিলো – সেই ব্যক্তিরাই পরবর্তীতে দিব্যি অন্য সাথীকে নিয়ে সন্তান-সন্ততি-পরিবারের সাথে সুখে-দুঃখে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে – এমন নিদর্শন ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে ৷
যাইহোক, গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” শিবের মাথার গঙ্গার নিম্নমুখী ধারা যেন জ্ঞানীর প্রেম, যা জীবজগতের কল্যাণের জন্য সতত নিম্নদিকে প্রবহমান। জগতে যত কিছু মহান কাজ হয়েছে – তার মূলে রয়েছে প্রেম !” গুরুজী বলেছিলেন – ” তিলমাত্র স্বার্থবুদ্ধি থাকলে পরমেশ্বরের বোধ হয় না, প্রেম জাগ্রত হয় না ৷” তাই শিব শ্মশানবাসী, তিনি সর্বত্যাগী শংকর ৷ সমস্ত ঐশ্বর্য ও সিদ্ধি থাকা সত্ত্বেও এইরূপে বিরাজ করতে পারা যায় একমাত্র প্রেমে ৷”