শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের শ্রীমুখ থেকে ‘ত্রিলোচন নীলকন্ঠ মহাদেব শিব’ সম্বন্ধে শোনা কথাগুলি এখানে পরিবেশন করা হচ্ছিলো ৷ গুরুমহারাজ __যে ধারাবাহিকভাবে একটাই সিটিং-এ এই কথাগুলি সব গরগর্ করে বলে দিয়েছিলেন – তা কিন্তু নয় ! আগেই বলা হয়েছে – উনি বিভিন্ন সময়ে ভোলা মহেশ্বর ‘শিব’ সম্বন্ধে যে সমস্ত আলোচনা করেছিলেন – তার কিছু কিছু অংশ (কারণ ওনার বলা সব কথা কারো পক্ষে কখনোই হুবহু বলা সম্ভব নয় ৷ তাছাড়া গুরুমহারাজ কথা বলতেন ‘পরা’ স্থিতি থেকে আর আমরা সাধারণ মানুষের সাধারণতঃ কথা বলি ‘বৈখরী’ থেকে !) এখানে পরিবেশনের চেষ্টা করা হোচ্ছে !

আগের আলোচনায় বলা হয়েছিল যে, কোনো সাধক যখনই সাধনার দ্বারা আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করতে পারে – তখনই সাধারণতঃ সেই সাধককে ‘শিবস্থিতি’-র মহাত্মা হিসাবে গন্য করা হয়। কিন্তু এর কারণ কি ? ব্যাপারটা হোলো – শিবকে বলা হয় ‘ত্রিলোচন’ অর্থাৎ তাঁর তিনটি নয়ন ৷ তাঁর তৃতীয় নয়নটি রয়েছে কপালের মধ্যস্থানে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে (আজ্ঞাচক্র ওই point-এর ভিতরে অবস্থিত ৷ চক্ষুও ভিতর থেকে বাইরের দিকে প্রকাশমান৷) ৷ শিবের তৃতীয় নয়নকে বলা হয় ‘হুতাশন’ বা অগ্নি ৷ এই অগ্নি জ্ঞানাগ্নি ৷ সাধক যখন তার সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে (চূড়ান্ত পর্যায় এই অর্থে যে, assending অবস্থার সর্বোচ্চ সাধনার ফল হোলো আজ্ঞাচক্রে স্থিতিলাভ ৷ এর থেকেও উন্নত অবস্থায় পৃথিবীগ্রহের মানব আর তার ‘শরীর’ নিয়ে যেতে পারে না ! তাই এর‌ও উপরের অবস্থা __আমরা দেখি desending-দের ক্ষেত্রে অর্থাৎ অবতারগণের ক্ষেত্রে!

জ্ঞানাগ্নিতে যখন সাধকের কামনা-বাসনার বীজ সিদ্ধ হয়ে যায়, তাঁর সমস্ত অজ্ঞানতা জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তিনি সেই ছাইভস্ম গায়ে মেখে শ্মশানবাসী ভোলানাথ হয়ে যোগস্থ অবস্থাই শুধু নয়, যোগারূঢ় অবস্থায় – শান্ত অবস্থায় বিরাজমান থাকেন ৷ এই অবস্থা লাভ হোলে তাঁর সান্নিধ্যে যারা থাকেন – তাদেরও ইন্দ্রিয়সকল শান্ত থাকে, ইন্দ্রিয়ের রাজা ‘মন’ একমুখী হয়ে যায় ! ওই সকল মানুষজনও অশান্তময় জীবনে শান্তির সন্ধান পান।

শিবের অন্যতম একটি নাম ত্রিপুরারি ! ত্রিপুরারি কথাটির অর্থ “ত্রিপুর”-নামক অসুর দমনকারী । তাছাড়া ত্রিগুণসম্পন্ন এবং ব্রহ্মগ্রন্থি, বিষ্ণুগ্রন্থি ও রুদ্রগ্রন্থি সমন্বিত মানব শরীরেই স্বর্গ- মর্ত-পাতাল রয়েছে ! এই মানবশরীরের রিপুসকল বা সাধন জীবনের বাধাসকল নাশ হয়__মাতা আদ্যাশক্তি-স্বরূপিনী কুলকুন্ডলিনী যখন রুদ্রগ্রন্থি ভেদ করে__তখন ৷ এইজন্যেই রুদ্রগ্রন্থির স্থানকে শিবস্থান বলা হয় ৷

দেবাদিদের মহাদেব ‘শিব’-কে নীলকন্ঠ বলা হয়েছে ৷ দেবাসুর মিলে সমুদ্রমন্থনের সময় ক্লান্ত বাসুকীনাগের মুখ থেকে ঝরা হলাহলে সমস্ত জীবজগৎ যখন নাশ হোতে বসেছিল – তখন ডাক পড়েছিল মহাদেবের ! তার আগে যখন উচ্চৈশ্রবা, ঐরাবত, লক্ষ্মী, বিভিন্ন মণিমুক্তা ইত্যাদি উঠেছিল – তখন সেগুলি নেবার সময় অন্য লোক ! কিন্তু যেই তীব্র কালকূট হলাহল উঠতে শুরু করলো – সেইটা নেবার আর লোক নাই ! – ডাক মহাদেব শিবকে !! আশুতোষ শিবের কাছে সমবেত প্রার্থনা জানাতেই শিব রাজি ! সেই তীব্র বিষ পান করে – তাঁর আবার সে কি কষ্ট ! শেষে মাতৃশক্তির বিগলিত প্রেমসুধা পানে সেই বিষ হজম হোলো – কিন্তু কন্ঠে রয়ে গেল, আর নীলবর্ণের ছাপ রেখে দিল ৷ তাই তিনি নীলকন্ঠ !

কিন্তু গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “এই বিশ্বসংসারে সদাসর্বদা দেবাসুরের সংগ্রাম হয়ে চলেছে। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, জ্ঞান-অজ্ঞানের দ্বন্দ্ব তো সবসময়েই রয়েছে। প্রতিটি মানবজীবনেও এই দ্বন্দ্ব রয়েছে। এখানে সমুদ্রমন্থন হোলো সাধন-ভজনের দ্বারা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে উর্ধ্বগামী করা ৷ মন্থনদন্ডরূপ মন্দার পর্বত এখানে মানবের মেরুদন্ড, কুলকুণ্ডলিনীই বাসুকী নাগ ৷ মন্থনের ফলে একে একে উঠে আসা সামগ্রীগুলি হোলো – সাধনের সিদ্ধিসমূহ। এই লোভনীয় সিদ্ধিসমূহ দিয়ে সাধককে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা হয়। কিন্তু যখন কোনো কিছুতেই সাধকের আসক্তি জন্মালো না, তখন শিবাবস্থা প্রাপ্ত হয় সাধকের। আর তখনই জীবজগতের সমস্ত পাপ-তাপ, কষ্ট-ক্লেশ, হাহাকার-কান্না ইত্যাদি সবকিছুর জ্বালা ওই শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত শরীরে প্রবেশ করতে চায়_এটাকে। তখনই মাতৃশক্তিরূপ প্রেমসুধা(চন্দ্রবারুনী সূধা) অঝোর ধারে বর্ষিত হয় সহস্রার থেকে – যার নিম্নগতি কন্ঠ পর্যন্ত ! এটাই নীলকন্ঠ হ‌ওয়ার তাৎপর্য।।

এইজন্যেই শিবস্থিতির মহাপুরুষের কাছে পৌঁছালেই তিনি তাঁর কন্ঠের সুমিষ্ট বাক্যে উপস্থিত জনেদের অশান্ত মনে শান্তির বারি সিঞ্চন করতে পারেন। যেকোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হোতে পারলেই তিনি মাত্র দু-চার কথায় সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন। এইজন্যেই মানুষও শিবের মহিমা, শিবস্তুতি, শিবকে প্রসন্ন করার মন্ত্র কীর্তন করে থাকে – ঐ শান্তির সন্ধানেই ৷৷